প্রাচীন বাংলা থেকে আধুনিক বাংলা পর্যন্ত বিভিন্ন স্তর সম্পর্কে আলোচনা কর
বাংলা ভাষার সুদীর্ঘ পথ পরিক্রমার বিভিন্ন স্তর সম্পর্কে পণ্ডিতগণ প্রায় একমত হলেও বিভিন্ন স্তরের সময় নির্ধারণে পণ্ডিতগণ দ্বিধাবিভক্ত। কেউ বলেন বাংলা ভাষার বিবর্তনের ইতিহাস প্রায় এক হাজার বছরের, আবার কেউ বলেন প্রায় দেড় হাজার বছরের কথা। তবে এ দীর্ঘ ইতিহাসের তিনটি পৃথক স্তর সম্পর্কে প্রায় সবাই একমত। স্তর তিনটি হচ্ছে –
ক. আদি বা প্রাচীন যুগ খ. মধ্য যুগ গ. আধুনিক যুগ।
ক. আদি বা প্রাচীন যুগ :
প্রাচীন বাংলা বা বাংলা ভাষার প্রাচীন যুগ সম্পর্কে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ধারণা, ৬৫০ খ্রি: থেকে ১২০০ খ্রি: পর্যন্ত প্রাচীন বাংলা ভাষার সময়। ড. সুকুমার সেনের ধারণা, বাংলা ভাষার আদি স্তরের স্তিতিকাল আনুমানিক দশম হতে মধ্য চতুর্দশ শতাব্দ অর্থাৎ ৯০০-১৩৫০ খ্রি: পর্যন্ত। ড.সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় চর্যাপদের আদি কবি লুইপাদের সময় হিসেব করে নির্ধারণ করেছেন ৯৫০ খ্রি: হতে ১২০০ খ্রি: পর্যন্ত বাংলা ভাষার প্রাচীন যুগের সময়-সীমা ।
ড.সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মনে করেন, ৬০০ হতে ১০০০ খ্রি: পর্যন্ত সময় অপভ্রংশের যুগ, তারপর নব্য ভারতীয় আর্য ভাষার উৎপত্তি। তিনি উল্লেখ করেছেন, “খ্রিস্টীয় ৯০০ হইতে ১২০০-র মধ্যে রচিত ‘চর্যাপদ নামে পরিচিত কতকগুলি বৌদ্ধ সহজিয়া মতের গানে আমরা বাঙ্গালা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন পাই । তৎপূর্বে বাঙ্গালা ভাষার অস্তিত্ব ছিল না।” তিনি উল্লেখ করেছেন, ৭০০ বা ৮০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে ‘মাগধী অপভ্রংশ’ নামে একটি প্রাকৃত ভাষা পূর্ব- ভারতে প্রচলিত ছিল ; এ প্রাকৃত (মাগধী অপভ্রংশ) ভাষার ভেতরেই অন্যান্য ভাষার সাথে বাংলা ভাষাও নিহিত ছিল । ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় দেখিয়েছেন যে, দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে বন্দ্যঘটীয় সর্বানন্দের অমরকোষের টীকায় চার-শ এর বেশি বাংলা, আধা-সংস্কৃত, তদ্ভব ও দেশী শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া একই সময়ে কিছু ভূমি দানপত্র এবং শিলালিপিতে স্থাননাম পাওয়া যায় এগুলােই প্রধানত আদিযুগের বাংলা ভাষার ঐতিহাসিক উপাদান।
খ. অন্ধকার যুগ
বাংলা ভাষার তিনটি যুগ (প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক) ছাড়াও প্রাচীন যুগের শেষ এবং মধ্যযুগের শুরুতে পণ্ডিতগণ আরাে একটি পৃথক যুগের কথা স্বীকার করেছেন। কেউ এ যুগটির নাম দিয়েছেন সন্ধিযুগ, আবার কেউ একে অন্ধকার যুগ বা অনুর্বর যুগ। যুগটির সময় ১২০০-১৩৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত । কোনাে কোনাে পণ্ডিত এ সময়টিকে ১৩০০-১৪০০ খ্রিস্টাব্দ; ১২০০-১৪৫০ খ্রিস্টাব্দ (ড. সুকুমার সেন) বলেও অনুমান করেছেন। যারা এ সময়টিকে অন্ধকার যুগ বা অনুর্বর পর্ব বলে অভিহিত করেছেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, ড. সুকুমার সেন প্রমুখ ভারতীয় পণ্ডিতগণ। অপরদিকে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ড. এনামূল হক প্রমুখ পণ্ডিতগণ এ সময়টিকে সন্ধিযুগ বলে উল্লেখ করেছেন। ভারতীয় পণ্ডিতগণ কেন এ সময়টিকে অন্ধকার যুগ বলেছেন- প্রথমেই এ বিষয়ে আলােচনা করছি।
ভারতীয় পণ্ডিতগণ উল্লেখ করেছেন ১২০০ থেকে ১৩৫০ বা ১৪৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার জীবন ও সংস্কৃতি, তুর্কি আঘাতে ও সংঘাতে, ধ্বংসে ও অরাজকতায়, মূৰ্ছিত-অবসন্ন হয়েছিল । তুর্কিরা ছিল দুর্ধর্ষ ও ভয়ঙ্কর জাতি। তুর্কি আক্রমণের প্রথম দিকে যেখানেই তারা বিজয়ী হয়েছিল, সেখানেই তারা রক্তে ও আগুনে প্রাচীন সংস্কৃতির চিহ্ন বিলুপ্ত করতে দ্বিধা করেনি । দেশের মধ্যে শিক্ষা-সংস্কৃতির যেসব প্রধান কেন্দ্র ছিল, সেগুলাে বিধ্বস্ত হলাে এবং বুদ্ধি-বিদ্যা কৌশলে যারা শীর্ষস্থানীয় ছিলেন, তাঁরা বিপন্ন হলেন। এমনি এক বিভীষিকাময় অবস্থায় সাহিত্য লিখব বলে তখন কেউ-ই সাহিত্য রচনা করতে এগিয়ে আসেনি । খুব সম্ভব সে সময় কেউ কিছু সৃষ্টি করবার মতাে প্রেরণাই পায় নি । যদি সামান্য কিছু হয়েও থাকে, তবে তা ছিল সামাজিক কোনাে উদ্দেশ্যে বা প্রয়ােজনের তাগিদে।
অপরদিকে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ড. এনামূল হক প্রমুখ পণ্ডিতগণ ১২০০-১৩৫০ খ্রিস্টাব্দ অর্থাৎ দেড় শ বছরের ইতিহাসকে ‘সন্ধিযুগ’ বলে অভিহিত করেছেন। ড. শহীদুল্লাহ প্রমুখ পণ্ডিতগণ বিভিন্নভাবে দেখাতে চেষ্টা করেছেন ১২০০-১৩৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক শূন্যস্থান হলেও সেটি ছিল মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একটি প্রস্তুতিপর্বমূলক সময় । ড মুহম্মদ শহীদুল্লাহ উল্লেখ করেছেন, ১২০১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশে তুর্কি আক্রমণ হয় । সমস্ত বাংলা অধিকার করতে তুর্কিদের প্রায় ১০০ বছর লাগে। শান্তি ও শৃঙ্খলা স্থাপন করতে আরও প্রায় ৫০ বছর লেগে যায়। এই দেড় শ বছর বাংলা সাহিত্যের কোনাে নিদর্শন না পাওয়া গেলেও তিনি ঐ সময়টিকে ‘অন্ধকার যুগ’ না বলে ‘সন্ধিযুগ’ বলেছেন। ‘সন্ধিযুগ’ বলার কারণ হিসেবে তিনি মধ্যযুগীয় বাংলা ভাষার আদিম নিদর্শন ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের’ ভাষার প্রসঙ্গ এনেছেন। চতুর্দশ শতাব্দীর শেষ ভাগে মধ্যযুগের প্রথম কবি বড়ু চণ্ডীদাসের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। তাঁর রচিত শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ পরবর্তীকালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে প্রকাশিত হয় ।
গ. মধ্যযুগ :
বাংলা ভাষার মধ্যযুগের সময় নির্ধারণে পণ্ডিতগণের মধ্যে খুব বেশি মত পার্থক্য লক্ষ্য করা যায় না। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, মধ্যযুগের স্থিতিকাল ১৩৫০-১৮০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ১৪০০- ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। ড. সুকুমার সেনের মতে ১৩৫০-১৮০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত । পণ্ডিতগণ এই মধ্যযুগকে দুটি উপস্তরে বিভক্ত করেছেন ।
১. আদি-মধ্যযুগ
২. অন্ত্য-মধ্যযুগ
১. আদি-মধ্যযুগ : ড. সুনীতিকুমারের মতে আদি-মধ্যযুগের স্তিতিকাল ১৪০০-১৬০০ খ্রি: পর্যন্ত, ড. সুকুমার সেনের মতে আনুমানিক ১৩৫০-১৪৫০ খ্রিস্টাব্দ, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে ১৩৫০-১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দ এর স্থিতিকাল। ১৪০০ সালের পরে রচিত প্রাচীন গ্রন্থগুলাের অধিকাংশই অষ্টাদশ শতাব্দীতে নকল করা পুঁথিতে পাওয়ায় ঐ সময়ের ভাষা কতখানি অবিকৃত আছে- এ বিষয়েও তারা নিশ্চিত নন। তবে বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের পুঁথিতে খুব বেশি হস্তক্ষেপ না পড়ায়, তাতে আদি মধ্য বাংলার পরিচয় অনেকটা স্পষ্ট রয়েছে বলে তাদের ধারণা। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহও ভারতীয় পণ্ডিতগণের সাথে এ বিষয়ে একমত হয়ে বলেছেন- শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ভাষা চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতাব্দীর । আদি-মধ্যযুগের শেষে চৈতন্য প্রভাব বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে প্রবিষ্ট হয় কিন্তু তখনাে বাংলা ভাষায় হিন্দির প্রভাব পড়ে নাই।
২. অন্ত্য-মধ্যযুগ : ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ও ড. সুকুমার সেনের মতে ১৬০০ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অন্ত-মধ্যযুগ। ড রামেশ্বর অন্ত্য-মধ্য বাংলার স্থিতিকাল ধরেছেন আনুমানিক ১৫০০ থেকে ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ অন্ত্য-মধ্যযুগের স্থিতিকাল সামান্য এগিয়ে
নিয়ে ১৫৭৫ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ বলে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। অন্ত্য-মধ্যযুগ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অত্যন্ত উৎকৃষ্ট একটি সময়। ভাষার সমৃদ্ধ নিদর্শন মঙ্গলকাব্যের বিভিন্ন ধারা, গৌড়ীয় বৈষ্ণব সাহিত্য, রামায়ণ-মহাভারত-ভাগবতের অনুবাদ ইত্যাদিতে পাওয়া যায়। এ সময় থেকে বাংলা ভাষায় ফারসি প্রভাব পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। ফারসি ছাড়াও ওলন্দাজ, পুর্তগিজ প্রভৃতি ভাষার প্রচুর শব্দ বাংলা ভাষায় প্রবেশ করে। এ অন্ত্য-মধ্যযুগের শেষ সময়ে ফারসি এবং উর্দু-হিন্দির প্রভাবে মুসলমানি-বাংলার প্রচলন হয় এবং দোভাষী পুঁথি সাহিত্যের উদ্ভব ঘটে।
ঘ. আধুনিক যুগ :
১৮০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আধুনিক যুগ হিসেবে গণ্য হয়। তবে অনেকে আধুনিক বা নব্য যুগের সূত্রপাতের এ সময় সম্পর্কে ভিন্নমত পােষণ করেছেন। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের শুরুতে যে নিদর্শনগুলাে পাওয়া যায়, তাতে অন্ত্য-মধ্যযুগের প্রভাব বলিষ্ঠভাবে লক্ষিত ছিল।
ড. রামেশ্বর আধুনিক যুগের সূত্রপাত বলতে ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দের কথা উল্লেখ করেছেন। ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ এবং ড. সুকুমার সেনের ধারণায় আধুনিক যুগের সূত্রপাত অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধ বলে উল্লেখ করেছেন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ থেকেই বাংলা ভাষার নব্য যুগের সূত্রপাত হয়। তবে তিনি এ নব্যযুগকে দুটি স্তরে ভাগ করেছেন। তাঁর ধারণায় ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ হতে ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত নব্য বা আধুনিক যুগের আদিকাল এবং ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দ থেকে নব্য যুগের বর্তমান কালের শুরু । আধুনিক যুগের আদিকাল (১৮০০-১৮৬০ খ্রি:) প্রসঙ্গে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, এ সময়টি ছিল বাংলা গদ্য ও পদ্যের পরীক্ষামূলক একটি সময় । এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বাংলা গদ্য ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও অক্ষয়কুমার দত্তে এবং পদ্য ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ও রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ে এসে যে রূপ পায়, তা নানান সংস্কারের ভেতর দিয়ে বর্তমান বাংলা সাহিত্যের বাহন হয়েছে। কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত, সাহিত্যিক ও ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্রকে এজন্য আধুনিক বাংলার প্রবর্তক বলা হয়। আধুনিক যুগে বাঙালির মুখের বাংলা ভাষাই এ পর্বের বাংলার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। এ পর্বের বাংলার নিদর্শন আমরা পাই- ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিত ও খ্রিস্টান মিশনারিদের হাতে রচিত বাংলা গ্রন্থ, রামমােহন-বিদ্যাসাগর-বঙ্কিমচন্দ্র-মধুসূদন রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্র প্রমুখ সাহিত্যিক ও পণ্ডিতগণের রচনায়।
Pingback: বাংলা ভাষার ইতিহাস ও ব্যবহারিক বাংলা সাজেসন্স | Cholo Shekhe