বাংলা ভাষায় আর্য প্রভাব
বাংলা ভাষা সময়ে সাথে সাথে বিভিন্ন ভাষার শব্দ দ্বারা সমৃদ্ধ হয়েছে।আর্য,অনার্য,বৈদেশিক ভাষা দ্বারা বাংলা ভাষা প্রভাবিত হয়েছে।আর্যরা বাংলার প্রাচীন অধিবাসী নয়। তারা পাক-ভারতের উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে ক্রমশ অগ্রসর হয়ে বাংলা পর্যন্ত তাদের অধিকার বিস্তৃত করে। তাদের আগমনের আগে বাংলায় অনার্যরা বাস করত।বগুড়ার মহাস্থানগড়ে মৌর্ষযুগের যে অনুশাসন লিপি আবিষ্কৃত হয়েছে, তাতে বোঝা যায় মৌর্য যুগে উত্তরবঙ্গে আর্য প্রভুত্ব স্থাপিত হয়েছিল ।
ভারতবর্ষে আর্যদের আগমন ঘটে আনুমানিক খ্রি.পূর্ব ১৫০০ অব্দ থেকে। একাধিক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলেতারা এসেছিল। আর্যদের ভাষা ও সাহিত্য ছিল প্রবল শক্তিশালী। তারা ছিল যাযাবর; তবে কুষিজীবী। ভারতীয় আর্যদের নিকট সম্পর্কিত উপভাষাগুলাের সাহিত্যিক রূপ ছিল ‘সাধুভাষা’ । এ ভাষাতেই তারা দেব মহিমাসূচক স্তবকগুলাে রচনা করেছিল। বৈদিক (ঋগবেদ) ভাষাই হচ্ছে ভারতীয় আর্য ভাষার প্রাচীনতম সাহিত্যিক রূপ। প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষা স্তরের পরবর্তীকালীন ইতিহাস বিচার করলে দেখা যায় যে, বাংলা ভাষায় আধুনিক রূপের উপর প্রাচীন ভারতীয় আর্য, মধ্যভারতীয় ও নব্য ভারতীয় আর্য স্তরের প্রভাব ও সম্পর্ক নিবিড় ।
ভাষার মুখ্য সম্পদ হল শব্দভাণ্ডার। বাংলা শব্দ প্রধানত দুই শ্রেণির মৌলিক ও আগন্তুক বা কৃতঋণ শব্দ। মৌলিক শব্দরাশি ভারতীয় আর্য ভাষা থেকে গৃহীত। মৌলিক শব্দগুলাে তিনটি শ্রেণিতে বিন্যস্ত-
১. তৎসম
২. অর্ধতৎসম
৩. তদ্ভব
১। তৎসম : যে শব্দসমূহ আধুনিক বাংলায় সংস্কৃত ভাষা থেকে অপরিবর্তিতভাবে গৃহীত হয়েছে সেগুলােকে তৎসম শব্দ বলে । যেমন- জল, বায়ু, আকাশ, মানুষ, গৃহ, কৃষ্ণ, অন্ন প্রভৃতি। ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, “কথিত ভাষার পার্শ্বে বিদ্যমান সংস্কৃত থেকে শব্দাবলী ইচ্ছামত কথিত ভাষায় গৃহীত হইয়া আসিতেছে। এইসব শব্দকে আধুনিক ভাষায় তৎসম শব্দ বলা হয়”।বাংলা ভাষায় তৎসম শব্দের ব্যবহার গড়ে শতকরা চুয়াল্লিশ ভাগ ।
২। অর্ধতৎসম শব্দ : যে সমস্ত সংস্কৃত শব্দ উচ্চারণ বৈশিষ্ট্যের প্রভাবে কিঞ্চিত বিকৃত হয়ে বাঙলায় গৃহীত হয়েছে সেগুলােকে অর্ধতৎসম শব্দ বলে। ড. সুকুমার সেনের মতে, “পুরানাে তৎসম শব্দই আধুনিকতম অর্ধতৎসম।” কথ্য ভাষায় অর্ধতৎসম শব্দের ব্যবহার বেশ লক্ষণীয় । যেমন- কৃষ্ণ > কেষ্ট (কানু); চিত্র > চিত্তির (চিতা); শ্রদ্ধা > ছেদ্দা (সাধ); বৈদ্য > বদ্দি; রাত্রি > রাত্তির (রাত)।
৩। তদ্ভব শব্দ : তদ্ভব শব্দগুলােই বাংলা ভাষায় শব্দভাণ্ডারের নিজস্ব সম্পদ। যে সকল শব্দ ভারতীয় আর্যের বিভিন্ন স্তরের মধ্য দিয়ে ধারাবাহিক পরিবর্তন লাভ করে বাংলায় গৃহীত হয়েছে সেগুলােকে বাংলায় তদ্ভব শব্দ বলে ।
বাংলা ভাষায় আর্য প্রভাব সর্বাধিক। কারণ আর্যদের ভাষা ও সংস্কৃতি ভারতবর্ষে যে আধিপত্য বিস্তার করেছিল তারই প্রভাবে দ্রাবিড় ও অনার্যদের ভাষা ও সংস্কৃতির চিত্র পরিবর্তিত হয়েছে। বাংলা ভাষার উপর আর্য প্রভাবের স্বরূপ বিশ্লেষণ করতে হলে ধ্বনি, শব্দ ও রূপতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ প্রাসঙ্গিক। এক্ষেত্রে শব্দগত ও ব্যাকরণ সম্পর্কিত প্রসঙ্গগুলাে নিয়ে বিচার করা হল ।
Pingback: বাংলা ভাষার ইতিহাস ও ব্যবহারিক বাংলা সাজেসন্স | Cholo Shekhe