বাংলা ভাষায় বৈদেশিক প্রভাব সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা কর

Spread the love

বাংলা ভাষায় বৈদেশিক প্রভাব সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা কর

বহু প্রকার বিচিত্র শব্দ সম্ভার বাংলা ভাষার গৌরব বৃদ্ধি করেছে । ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক কারণে প্রাচীনকাল থেকে এদেশে বহু জাতির আগমন ঘটেছে। সে সব জাতির সাথে আদান-প্রদান ও সংমিশ্রণের ফলে তাদের ভাষার বহু শব্দ বাংলা ভাষায় গৃহীত হয়েছে। বাংলা ভাষার উৎপত্তির পরে অন্যান্য ভাষা থেকে যেসব শব্দ এ ভাষায় এসেছে, সে আগন্তুক শব্দ গুলো হচ্ছে বাংলার বিদেশী উপাদান।

ফারসি শব্দ : বাংলা ভাষায় আগম্ভক বিদেশী শব্দগুলাের মধ্যে ফারসি শব্দের প্রভাব সব থেকে বেশি। এ ফারসির মাধ্যমে আরাে দুটো ভাষা এসেছে- তুর্কি ও আরবি। বাংলাদেশে মুসলিম আধিপত্যের প্রায় সাড়ে পাঁচশত বছরের ঘনিষ্ঠতার ফলে ফারসি ভাষার বহু শব্দ বাংলা ভাষায় প্রবেশ ঘটে। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলায় প্রায় আড়াই হাজার শব্দ ফারসি অথবা ফারসির ভেতর দিয়ে আরবি ও তুর্কি হতে এসেছে। বাংলায় মুসলিম আধিপত্যের প্রথম তিন শতাব্দী ফারসি শব্দ বাংলায় বেশি না এলেও ষােড়শ শতাব্দীর শেষভাগ হতে, বিশেষ করে মুঘল শাসন শুরুর পর এ জাতীয় শব্দের প্রচুর প্রবেশ ঘটেছে। এটা অব্যাহত ছিল অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত । এরপর বিগত শতাব্দীর তিরিশের দশকে যখন ফারসির পরিবর্তে বাংলা ও ইংরেজি আইন-আদালত ও শাসন-কার্যের ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন থেকেই ফারসির প্রভাব কমতে শুরু করে। কিন্তু ফারসি শব্দগুলাে বাংলা ভাষায় এমনভাবে শিকড় গেড়ে তখন থেকে রয়েছে যে, সেগুলাে এখনাে বাংলার প্রয়ােজনীয় শব্দগুলাের অন্তর্গত।

ফারসি ভাষা থেকে আগত শব্দগুলােকে বোঝার সুবিধার্থে সাত ভাগে ভাগ করা যায়। যথা :-

১. রাজ্য, যুদ্ধ-বিগ্রহ সম্বন্ধীয়- বাদশাহ, নবাব, বেগম, তীর, তােপ, ইত্যাদি।
২. আইন-আদালত সংক্রান্ত- আদালত, মুন্সেফ, মোকদ্দমা, আইন- কানুন, হাকিম, উকিল; ইত্যাদি।
৩. ধর্ম-বিষয়ক – খােদা, নামাজ, মৌলভি, কোরবানি, হারাম, জাহান্নাম; ইত্যাদি।
৪. শিক্ষা বিষয়ক – কাগজ, কলম, কেতাব, মক্তব, হরফ, আলেম,আদব ইত্যাদি।
৫. জাতি বা ব্যবসাবাচক- হিন্দু, ইহুদি, ফিরিঙ্গি, দরজি, মেথর, যাদুকর; ইত্যাদি।
৬. সাধারণ দ্রব্য সম্পর্কিত- হাওয়া, পছন্দ, লাল, সাদা, নরম, পেশা; ইত্যাদি।

তুর্কি শব্দ : আরবি-ফারসি মাধ্যমে বাংলা ভাষার শব্দ ভাণ্ডারে কিছু তুর্কি শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। আরবি ফারসি মাধ্যম ছাড়াও কিছু কিছু শব্দ সােজাসুজি তুর্কি ভাষা থেকে বাংলা ভাষায় এসেছে। ড. এনামূল হক প্রমুখ এদেশের খ্যাতনামা পণ্ডিতগণের ধারণা, খ্রিস্টীয় ৮ম-৯ম শতাব্দীতে বাঙালিরা আরব বণিকদের সংস্পর্শে আসে এবং পূর্ব-দক্ষিণ বাংলার চট্টগ্রামে উভয়ের সম্মতিতে একটি উপনিবেশ গড়ে ওঠে। যার ফলে আরবি-ফারসি শব্দের সাথে কিছু তুর্কি শব্দও বাংলা ভাষায় চলে এসেছে। তুর্কি শব্দের কিছু নমুনা নিচে দেওয়া হলাে- 

তুর্কি : আলখাল্লা, উজবুক, কাচি, কাবু, কুলি, চাকু, চিক, বিবি, বোঁচকা, খাতুন, খা, খানম, গালিচা, তবক, বাবুর্চি, বেগম, সওগাত, মুচলেকা, লাশ, তুরুক, দারােগা, কোর্মা ইত্যাদি।

আরবি শব্দ : আরবি ষষ্ঠ-সপ্তম শতাব্দী থেকে ১২-১৩শ শতাব্দীতে ছড়িয়ে যায় ইরাক, ইরান, সিরিয়া, মিশর, উত্তর আফ্রিকায় এবং পরে ইউরােপের স্পেনে, এশিয়ার ভারতে, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া অঞ্চলে মুসলিম সম্রাজ্যের এবং ইসলাম ধর্মের বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে কালক্রমে পারস্য দেশের লােকেরা ভারতবর্ষে রাজকার্যে এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হওয়ায় ব্যবহারিক জীবনে ফারসির প্রভাব বৃদ্ধি পায়। আর আরবির প্রাধান্য রইল ধর্মীয় ব্যাপারে। বিশেষ করে মসজিদ, ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব এবং কিছু পরিমাণে ব্যবসায়িক লেনদেনের ক্ষেত্রে। 

আরবি : আইন, আক্কেল, হুকা, কেচ্ছা, খাসি, আয়েশ, বিদায়, জিলা, আতর, কেতাব, তাজ্জব, দফা, আদমি, এতিয়ার, উশুল, খাজনা, খারিজ, জমি, জমা, তহশিল, হিসাব, হিস্সা, আদালত, উকিল, দলিল, ফেরার, হাকিম, হেফাজৎ, আদব, কায়দা, কদম, দখল, হজম, সাফ; ইত্যাদি।

পর্তুগিজ শব্দ : বাংলা ভাষায় পর্তুগিজ শব্দের প্রভাব একেবারে কম নয়। পর্তুগিজরা ব্যবসা-বাণিজ্য উপলক্ষে এদেশে আসে ষােড়শ শতাব্দীতে। ঢাকা-চট্টগ্রাম- হুগলি অঞ্চলে তাদের বসবাস ছিল। ড. সুকুমার সেন পর্তুগিজদের সম্পর্কে বলেছেন- “অষ্টাদশ শতাব্দের মধ্যভাগ অবধি মিশনারিদের কার্যকলাপের দ্বারা। বাঙ্গালার সহিত তাহাদের যােগ কতকটা বজায় থাকে, যদিও দাস ব্যবসায় । জলদস্যুতা এবং উগ্রভাব ধর্ম প্রচারের জন্য তাহাদের সঙ্গে সে সম্পর্ক কখনই সহজ ও হৃদ্য ছিল না। ব্যবসা-বাণিজ্য সূত্রে এদের সাথে বাঙালিদের যােগাযােগ হওয়ার ফলে পর্তুগিজ ভাষার কিছু শব্দ বাংলায় চলে আসে। ১৮শ শতাব্দী থেকে বাংলা ভাষায় পর্তুগিজ শব্দের প্রভাব কমে আসে। তবুও পর্তুগিজ ভাষার যে শব্দগুলাে এখনাে বাংলা ভাষায় চালু রয়েছে, তার যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। বাংলা ভাষায় প্রচলিত পর্তুগিজ শব্দের কিছু নমুনা নিচে দেওয়া হলাে :

পর্তুগিজ শব্দ : আলকাতরা, আলপিন, আনারস, নােনা, আতা, আলমারি, ক্রুশ, গরাদ, জানালা, বালতি, বােতাম, বাসন, বােমা, কামিজ, কেরানি, চাবি, কপি, ফিতা, ফালতাে, গামলা, গুদাম, গির্জা, নিলাম, মার্কা, মিস্ত্রি, পেঁপে, পাউ (রুটি), পাচার, পেয়ারা, পেরেক, সাবান, সাগু, তােয়ালে, তামাক, বেহালা, বারান্দা; ইত্যাদি।

ফরাসি এবং ওলন্দাজ শব্দ : অষ্টাদশ শতাব্দীর দিকে অন্যান্য জাতির সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য উপলক্ষে ফরাসি (ফ্রেঞ্চ) এবং ওলন্দাজ (ডাচু) এদেশে আগমন করে। ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে এলেও ইংরেজদের মতাে এরাও কিছু কিছু রাজনৈতিক বিষয়ে এদেশে মানুষের সাথে সম্পৃক্ত হয়। তবে এদের রাজনৈতিক প্রভাব ইংরেজদের মতাে সুদৃঢ় ছিল না। বিভিন্ন কারণে বাঙালিদের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ায় বাংলা ভাষায় তাদের কিছু শব্দ প্রবেশ করেছে। তবে অন্যান্য ভাষার তুলনায় ফরাসি এবং ওলন্দাজ শব্দের পরিমাণ সামান্য।

ফরাসি শব্দ : কার্তুজ, কুপন, কাফে, রেস্তোরা, আঁতাৎ; ইত্যাদি।
ওলন্দাজ শব্দ : হরতন, রুইতন, ইশকাপন, তুরুপ, ইসকুপ; ইত্যাদি। 

ইংরেজি শব্দ : বাংলাদেশে ইংরেজদের আগমন ঘটে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে। তবে বাংলা ভাষায় ইংরেজি শব্দের ব্যাপক অনুপ্রবেশ ঘটে উনবিংশ শতাব্দীর গােড়ায়। ১৭৫৭ সালে পলাশি যুদ্ধে জয় লাভ করার পর এদেশে ইংরেজের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা শুরু হয় এবং বলতে গেলে এখান থেকেই গােটা ভারতে তাদের সাম্রাজ্যের পত্তন আরম্ভ হয়।

আদালতের ভাষা হিসেবে ইংরেজি প্রতিষ্ঠা পায় ১৮৩৬ সাল থেকে। বাংলাদেশ তো বটেই, গােটা ভারতবর্ষে বাঙালির দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় এবং চিন্তজগতের সর্বত্রই ইংরেজির প্রভাব ও প্রতিষ্ঠা চরম উৎকর্ষ লাভ করে। যার ফলে বাংলা ভাষার শব্দ ভাণ্ডারে ইংরেজি শব্দের অনুপ্রবেশ ছিল স্বাভাবিক একটি বিষয়। 

ইংরেজি শব্দ  চেয়ার, টোস্ট, ট্রেন, রেল, মেল, সিনেমা, কফি, হােটেল, ফিল্ম, থিয়েটার, টেলিফোন, শার্ট, কোট, কোর্ট, স্কুল, কলেজ, স্টল, ডিপুটি, ফটো, ফোন; ইত্যাদি।

বৈদেশিক শব্দ বাংলা শব্দের সাথে মিশে একাকার হয়ে গেছে। বাংলা ভাষায় উল্লিখিত বিদেশী শব্দগুলাের প্রভাব এতােটাই বেশি যে, বিদেশী শব্দ ছাড়া কারাে পক্ষেই কথা বলা অথবা কোনাে কিছু লেখা সম্ভব নয়। সংস্কৃত ভাষার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার ফলে নতুন শব্দ তৈরিতে বাংলা ভাষা যেমন দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে, অনুরূপভাবে ইংরেজিসহ অন্যান্য বিদেশী ভাষার সাথে গভীর সম্পর্কের কারণে বিদেশী শব্দগুলােকে বাংলায় আত্মীকরণ করতে সমান দক্ষতা দেখিয়েছে। বিদেশী শব্দগুলাে বাংলায় আত্মীকরণের ফলে বাংলা শব্দ ভাণ্ডার নিঃসন্দেহে সমৃদ্ধ হয়েছে।

1 thought on “বাংলা ভাষায় বৈদেশিক প্রভাব সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা কর”

  1. Pingback: বাংলা ভাষার ইতিহাস ও ব্যবহারিক বাংলা সাজেসন্স | Cholo Shekhe

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top