বাংলা ভাষার উৎপত্তি সম্পর্কে পণ্ডিতদের অভিমত বিচার করে তোমার মতামত উপস্থাপন কর

Spread the love

বাংলা ভাষার উৎপত্তি সম্পর্কে পণ্ডিতদের অভিমত বিচার করে  তোমার মতামত উপস্থাপন কর

পণ্ডিতগণ বাংলা ভাষার উৎপত্তি সম্পর্কে একমত নন। পণ্ডিতগণের ভিন্ন মত প্রধানত দুটি  বিষয়ের ওপর। একটি হচ্ছে- কোন্ ভাষা হতে বাংলা ভাষা এসেছে, বাংলা ভাষা উৎপত্তির সময়। আর এ বিষয়ে যাদের মতামত সর্বজন স্বীকৃত তাদের অন্যতম স্যার জর্জ গ্রিয়ারসন, ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, ড. সুকুমার সেন প্রমুখ পণ্ডিতগণের নাম উল্লেখ করা যায়। নিচে বাংলা ভাষা উৎপত্তি নিয়ে বিবিধ মত সম্পর্কে আলােচনা করা হলাে :

সংস্কৃত থেকে বাংলা ভাষার উৎপত্তি প্রসঙ্গে-   কোনাে কোনাে মহলে একটি ধারণা প্রচলিত রয়েছে যে, বাংলা সংস্কৃতের দুহিতা, অর্থাৎ সংস্কৃত থেকে বাংলা ভাষা উৎপত্তি হয়েছে । কিন্তু বাংলা ভাষা উৎপত্তি নিয়ে পণ্ডিতগণের নানা বিচার-বিশ্লেষণে দেখা যায়, সংস্কৃত থেকে বাংলা ভাষা সরাসরি উৎপন্ন হয়নি। প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষা থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ভাষার যে ইতিহাস পাওয়া যায় তাতে দেখা যায়- বাংলার পূর্বে অপভ্রংশ, তার পূর্বে ছিল প্রাকৃত ভাষার যুগ। প্রাকৃত ভাষার যুগে সংস্কৃত ছিল একটি সাহিত্যিক ভাষা। ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের মধ্যে এ ভাষার প্রচলন থাকলেও সাধারণ মানুষ এ ভাষা ব্যবহার করতাে না। সংস্কৃত যে একটি ভাষার সাহিত্যিক রূপ- এ কথা ড. সুকুমার সেন স্বীকার করেছেন। তিনি তার ‘ভাষার ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থে বলেছেন “সংস্কৃত হইল বৈদিক যুগের অন্তে কথ্য ভাষা হইতে লেখ্য ভাষায় প্রত্যাবর্তন। সেকালে সংস্কৃত বলিয়া বৈদিক হইতে ভিন্নতর ভাষা বুঝাইত না।” স্যার জর্জ গ্রিয়ারসন, ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রমুখ পণ্ডিতগণও স্বীকার করেননি যে, সংস্কৃত থেকে বাংলা ভাষা এসেছে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এ প্রসঙ্গে বলেছেন, “সংস্কৃত যুগ বলিয়া আমরা একটি পৃথক যুগ কল্পনা করিতে পারি এবং সংস্কৃতের সহিত বাংলার কোনও সাক্ষাৎ সম্পর্ক নাই।” তিনি তার বক্তব্যের স্বপক্ষে প্রচলিত কিছু শব্দের দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন। সংস্কৃতের সাথে যে বাংলার কোনাে সাক্ষাৎ সম্পর্ক নেই নিচের ছকের দিকে লক্ষ্য করলে তা স্পষ্ট হবে :

সংস্কৃত প্রকৃতবাংলা
পিতাবপপবাপ
মাতামাআমা
হস্তহথহাত
বৃক্ষগচ্ছগাছ
নাসিকানক্কনাক
ভগিনীবহিনীবোন

সুতরাং এটা সুস্পষ্ট যে, প্রাকৃত থেকে ক্রমশ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে শব্দগুলাে বাংলায় পাওয়া যাচ্ছে। অতএব এরূপ আরাে অনেক প্রমাণ দ্বারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায় বাংলা সরাসরি সংস্কৃত থেকে আসেনি ; কিন্তু সংস্কৃতের সমগােত্রীয় এক প্রাচীন আর্য কথ্য ভাষা থেকে এর উৎপত্তি হয়েছে। নিচে এ সম্পর্কিত একটি ছক দেওয়া হলাে :

প্রাচীন-ভারতীয়-আর্য

মাগধী প্রাকৃত থেকে বাংলা ভাষার উৎপত্তি প্রসঙ্গে : পূর্বেই উল্লেখ করেছি, সংস্কৃত থেকে বাংলা ভাষার উৎপত্তি ঘটেনি। সংস্কৃত ছিল সে সময়ের একটি সাহিত্যিক ভাষা বা লেখার ভাষা- কথ্য ভাষা নয় । সাধারণ মানুষ কথা বলতাে প্রাকৃত ভাষায়। প্রাকৃতই ছিল সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের কথ্য ভাষা। কিন্তু সে সময় নানা রকম প্রাকৃত ভাষা ছিল ভারতবর্ষে। প্রাকৃত ভাষাগুলােকে বলা হয় ‘মধ্যভারতীয় আর্য ভাষা’ । আনুমানিক খ্রি: পূ: ৪০০ অব্দ থেকে ১০০ খ্রি: পর্যন্ত এ ভাষাগুলাে কথ্য ও লিখিত ভাষারূপে ভারতের বিভিন্ন স্থানে প্রচলিত থাকে। এ প্রাকৃত ভাষাগুলাের শেষ স্তরের নাম অপভ্রংশ বা অবহটঠ। এ রকম একটি অপভ্রংশের নাম ‘মাগধী অপভ্রংশ’। স্যার জর্জ গ্রিয়ারসনের ধারণা, মাগধী প্রাকৃতের কোনাে পূর্বাঞ্চলীয় অর্থাৎ পূর্ব মাগধী অপভ্রংশ থেকেই জন্ম নিয়েছে বাংলা, আসামি ও উড়িয়া ভাষা। ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় জর্জ গ্রিয়ারসনের এ মত সমর্থন করেছেন ।

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ স্যার জর্জ গ্রিয়ারসন ও ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মত সমর্থন না করে ভিন্নমত পােষণ করেন । তিনি ভাষার ধ্বনিতাত্ত্বিক, রূপতাত্ত্বিক ইত্যাদি বিশ্লেষণ করে দেখানাের চেষ্টা করেছেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে মাগধী প্রাকৃত বা মাগধী অপভ্রংশের সাথে বাংলা ভাষার কিছু সাদৃশ্য থাকলেও মাগধী প্রাকৃত থেকে বাংলা ভাষার উদ্ভব ঘটেনি। মাগধী প্রাকৃতের সাথে বাংলার যে সাদৃশ্য রয়েছে তা হচ্ছে বাংলায় শ স ষ স্থানে শ হয় (উচ্চারণ), অর্থাৎ বাংলায় একটি মাত্র শ ধ্বনি ব্যবহৃত হয় মাগধী প্রাকৃতেও তাই। মাগধী প্রাকৃতে কর্তৃকারকে ‘এ’ বিভক্তির প্রয়ােগ হয় বাংলায়ও সেরূপ। ড. শহীদুল্লাহ বলেন, মাগধীতে ‘র’ স্থানে ‘ল’ হয় কিন্তু বাংলা সহােদরা স্থানীয় কোনাে ভাষাতেই শ-কার র-কার স্থানে ল-কার- এ পরিবর্তন এক সাথে দেখা যায় না। উপযুক্ত যুক্তি ছাড়াও ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ জর্জ গ্রিয়ারসন ও ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের যুক্তি খণ্ডনের জন্য এ-কার বিভক্তির প্রসঙ্গ এনেছেন। তিনি যুক্তি দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন- কর্তৃকারকের ‘এ’-কার মাগধী প্রাকৃতের বিশেষ লক্ষণ নয় । অশােকের প্রাচ্য অনুশাসনে এবং অর্ধমাগধীতেও এ-কার দেখা যায়। আসামি ভাষায় সকর্মক ক্রিয়ার কর্তায় এ-কার দেখা যায়, কিন্তু অকর্মক ক্রিয়ার কর্তায় বিভক্তি লােপ পায়। মাগধীর এ-কার প্রসঙ্গে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন- “অতীত ও ভবিষ্যৎকালের কর্মবাচ্য প্রয়ােগ হইতে বর্তমান কালের কর্মবাচ্যে এ-কার আসিয়াছে। ইহার সহিত মাগধীর কর্তায় এ-কারের কোনও সম্পর্ক নাই।”

মাগধী প্রাকৃতের ধ্বনিতত্ত্বের আর একটি লক্ষণ- সংস্কৃত বর্গীয় ‘জ’ স্থানে ‘য়’ ; মাগধী প্রাকৃত ছাড়া অন্য প্রাকৃতে ‘জ্জ’ স্থানে মাগধীতে ‘যয়’ হয়। যেমন

সংস্কৃত– জল ; মাগধী -য়ল।
সংস্কৃত– কার্য ; মাগধী – কয়্য।
সংস্কৃত- অদ্য ; মাগধী – অয়্য।
সংস্কৃত ‘কার্য’ ও ‘অদ্য’ মহারাষ্ট্ৰীতে কজ্জ’ ও ‘অজ্জ’ বলা হয়। বর্গীয় ‘জ’ স্থানে ‘য়’ কিংবা ‘জ্জ’ স্থানে মাগধীতে ‘য়য়’- এ ভিন্ন উচ্চারণ দেখে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ধারণা ‘জল’ ‘কাজ’ ‘আজ’ শব্দগুলাে কোনাে ভাবেই মাগধী প্রাকৃত হতে আসতে পারে না।

গৌড়ী প্রাকৃত ও বাংলা : ভারতীয় আর্য ভাষার স্তর বিভাগ থেকে দেখা যায়, প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষা (বৈদিক ও সংস্কৃত) পরিবর্তিত হয়ে মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষার স্তরে আসে। প্রথমে পালি এবং পরে প্রাকৃত ভাষা নামে তা চিহ্নিত হয়। অঞ্চল ভেদে প্রাকৃত ভাষা কয়েকটি শ্রেণিতে বিভক্ত হয়ে যায়- যার একটি ছিল মাগধী প্রাকৃত। এই মাগধী প্রাকৃতের প্রাচ্যতর রূপ গৌড়ী প্রাকৃত। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের সাহায্যে গৌড়ী প্রকৃতের কয়েকটি বিশিষ্ট লক্ষণ নির্দেশ করেছেন।

(ক) এতে প্রাকৃতের অনুরূপ ‘ণ’ হবে ‘ন’ স্থানে ।
(খ) শব্দের আদিতে অন্তঃস্থ ‘ব’ বর্গীয় রূপে ছিল ।
(গ) এতে মহারাষ্ট্রী প্রাকৃতের মতাে আদি য স্থানে জ হতাে।
(ঘ) ‘র’ বর্ণের কোনাে পরিবর্তন হতাে না।
(ঙ) সম্ভবত মহারাষ্ট্রী প্রাকৃতের মতাে শ, ষ, স স্থানে স হতাে।
এ গৌড়ী প্রাকৃতের পরিণত অবস্থা গৌড় অপভ্রংশ এবং সেখান থেকেই বাংলা ভাষার উৎপত্তি হয়েছে। এ পর্যায়ের অন্যান্য ভাষা হলাে মৈথিলি, মাগধি, ভােজপুরিয়া, আসামি ও উড়িয়া । এবার গৌড়ী অপভ্রংশ বিশ্লেষণ করে দেখানাের চেষ্টা করবাে- বাংলা ভাষার সাথে এর সম্পর্ক কীরূপ ।

গৌড়ী অপভ্রংশ ও বাংলা : পূর্বেই উল্লেখ করেছি, গৌড়ী অপভ্রংশ বাংলার অব্যবহিত পূর্বের রূপ। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, এখান থেকেই বাংলা ভাষার উৎপত্তি ঘটেছে। প্রাকৃত বৈয়াকরণ মার্কেণ্ডেয় ২৭টি অপভ্রংশের যে তালিকা দিয়েছেন, তাতে এ অপভ্রংশের কথা উল্লেখ রয়েছে। কাহ্নপাদ এবং সরহপাদের দোহার ভাষায় গৌড়ী অপভ্রংশের নমুনা দেখা যায়। গৌড়ী অপভ্রংশের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ উল্লেখ করেছেন। নিচে তা তুলে ধরা হলাে :

(ক) কর্তা ও কর্মে বিভক্তি লােপ পায়।
(খ) নামযুক্ত বাক্যে (Nominal sentence) কর্তায় ও বিধেয় বিশেষণে কখনাে কখনাে অ-কারান্ত শব্দে এ-কার যুক্ত হয় ।
(গ) সম্বন্ধ পদ বিশেষণের মতাে সম্বন্ধীয় বিশেষ্যের অনুরূপ হয়।
(ঘ) সকর্মক ক্রিয়ার অতীত ও ভবিষ্যৎ কালে ক্রিয়া কর্মের অনুরূপ হয়।
গৌড়ী অপভ্রংশ গৌড়ী প্রাকৃতেরই পরিণত অবস্থা। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, এ গৌড় অপভ্রংশ থেকে সর্বপ্রথম বিহারি ভাষা উৎপন্ন হয়ে পৃথক হয়ে যায়। তারপর উড়িয়া ভাষা, তারপর বঙ্গ কামরূপি ভাষা। এ বঙ্গ কামরূপি ভাষা দু ভাগে বিভক্ত হয়ে বাংলা ও আসামি ভাষায় পরিণত হয়েছে।
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতানুসারে মূল ইন্দো-ইউরােপীয় ভাষাগােষ্ঠী হতে বাংলা ভাষা পর্যন্ত ক্রমধারার একটি রেখাচিত্র :

ইন্দো-ইউরোপীয়-ভাষাগোষ্ঠী

1 thought on “বাংলা ভাষার উৎপত্তি সম্পর্কে পণ্ডিতদের অভিমত বিচার করে তোমার মতামত উপস্থাপন কর”

  1. Pingback: বাংলা ভাষার ইতিহাস ও ব্যবহারিক বাংলা সাজেসন্স | Cholo Shekhe

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top