বিরাম চিহ্ন ব্যবহারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ভূমিকা আলোচনা কর

Spread the love

বিরাম চিহ্ন ব্যবহারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ভূমিকা আলোচনা কর

বিরাম চিহ্নের ইংরেজি প্রতিশব্দ Punctuation। গ্রিক Punctus থেকে ইংরেজি Punctuation শব্দটি এসেছে। Punctus অর্থ বিন্দু বা point । প্রথম দিকে এ বিন্দু হিব্রু ভাষায় ব্যঞ্জনধ্বনির সঙ্গে স্বরধ্বনির সংকেত হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। পঞ্চদশ শতকে এসে এটি Period of full stop হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। অন্যান্য বিরামচিহ্নগুলাে বর্তমানে যে অর্থে, যেভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে প্রাচীনকালে ঠিক এমনটি ছিল না। সময়ের ব্যবধানে, বিবর্তনের মাধ্যমে বর্তমান রূপ ও অর্থ ধারণ করেছে। কোন বিরাম চিহ্ন বর্তমানে লােপ পেয়েছে। 

লেখ্য ভাষায় বক্তব্যকে যথাযথ ভাবে প্রকাশ করার জন্যে কতকগুলাে চিহ্ন ব্যবহার করা হয়, সে সব চিহ্নকে বিরাম চিহ্ন বা যতি চিহ্ন বলে। একটু লক্ষ করলেই দেখা যাবে যে, কথা বলার সময় মানুষ এক নাগাড়ে শব্দ উচ্চারণ করে না। মাঝে মাঝে সে বেশি থামে, মাঝে মাঝে কম সময় থাকে আবার কখনো কখনাে কণ্ঠস্বরের উঠা-নামার কারণে শ্রোতার কাছে মনােভাব স্পষ্টভাবে প্রকাশ পায়। লেখায় বা মুদ্রণে উল্লিখিত থামা ও কণ্ঠস্বরের পরিবর্তনের কাজটি করার জন্যে বিরামচিহ্নগুলাে প্রয়ােগ করা হয় ।

লেখ্য ভাষায় বিরাম চিহ্নের কাজগুলাে মােটামুটি এরূপ-
১. বিরাম চিহ্ন বাক্যের সমাপ্তি ঘােষণা করে ।
২. বাক্য উচ্চারণে কণ্ঠস্বর কেমন হবে তা নির্দেশ করে।
৩. বাক্যস্থিত দুটি পদের মধ্যে সম্পর্ক সৃষ্টি করে ।
৪. বাক্যস্থিত দুটি পদের মধ্যে সম্পর্কহীনতা প্রকাশ করে ।
৫. জটিল, যৌগিক বাক্যের মধ্যেকার দুই বা ততােধিক খণ্ড বাক্যের মধ্যেকার সম্পর্ক নির্ণয় করে ।

প্রাচীন ও মধ্যযুগে বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত হতো কেবল দাঁড়ি। কখনো এক দাড়ি (।), কখনাে দুই দাঁড়ি (।।)। সাধারণ কবিতার প্রথম চরণে এক দাড়ি এবং দ্বিতীয় চরণে দুই দাড়ি ব্যবহৃত হতাে। যেমন-

কাআ তরুবর পাঞ্চ বি ডাল ।
চঞ্চল চী এ পইঠা কাল ॥ -(চর্যাপদ- প্রাচীনযুগ)

মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান ॥-(মহাভারত-কাশীরাম দাস- মধ্যযুগ)

বাংলা পদ্য ও কবিতায় দাড়ি ছাড়া অন্যান্য বিরাম চিহ্নগুলাের ব্যবহার শুরু হয় আধুনিক যুগে এসে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরই প্রথম বাংলা গদ্যে ইংরেজির অনুসরণে বিরাম চিহ্নের প্রয়ােগ করেন। বিদ্যাসাগরের পূর্ববর্তী বাংলা গদ্যেও কেবল দাঁড়িই ব্যবহৃত হতাে। বাংলা ভাষায় সব মিলিয়ে এখন ১৭টি বিরাম চিহ্ন দেখা যায়। অবশ্য বহুল ব্যবহৃত বিরাম চিহ্ন ১০টির মতাে। এই বিরাম চিহ্নগুলাের মধ্যে এক দাড়ি (।), দুই দাড়ি (।।) ইত্যাদি বিরাম চিহ্ন প্রাচীন পাণ্ডুলিপিতে দেখা যায়। বর্তমানে এক দাড়ি (।) ছাড়া অন্যান্য বিরাম চিহ্নগুলাে আর বাংলায় ব্যবহৃত হয় না। বাংলায় ব্যবহৃত অন্যান্য বিরাম চিহ্নগুলাে এসেছে ইংরেজি ভাষা থেকে।

বাংলা ভাষা ও বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস এক হাজার বছরের কিছু বেশি। কিন্তু বাংলা ভাষায় সুষ্ঠুভাবে বিরামচিহ্ন ব্যবহার শুরু হয়েছে দেড়শ দুইশ বছর আগে। প্রকৃতপক্ষে বাংলা গদ্য ভাষার ব্যাপক ব্যবহারের সূত্রে বিরাম চিহ্ন প্রয়ােগের নিয়মনীতি প্রতিষ্ঠত হয়েছে। 

বাংলা ভাষার মধ্যযুগের শেষ হয় আঠার শতকে। উনিশ শতকে গদ্যের উদ্ভব হয়েছে। গদ্য কাজের ভাষা। জীবনের নানা প্রয়ােজনে তখন থেকে গদ্যের ব্যবহার হচ্ছে। গদ্যের জন্য বিরাম চিহ্ন ব্যবহারের গুরুতর প্রয়ােজন দেখা দিল। বাংলা গদ্যের সাহিত্যিক লিখিত রূপ প্রথম পাওয়া গেল ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পাঠ্য পুস্তকগুলােতে।বিরাম চিহ্নের জন্য স্মরণীয় ব্যক্তি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১)। তিনি বাংলা গদ্যে বিরাম চিহ্ন ব্যবহারের নৈপুণ্য দেখালেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে রবীন্দ্রনাথ বাংলা গদ্যের জনক বলেছেন। আসলে “বিদ্যাসাগরই বাংলা গদ্যকে যথার্থভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি গদ্য লেখার নিয়মকানুন আবিষ্কার করেন। গদ্য পদ্যের মতাে ছন্দোবদ্ধ রচনা নয়, কিন্তু গদ্যেরও ছন্দ আছে। বিরামচিহ্ন ঠিকভাবে ব্যবহার করে বিদ্যাসাগর গদ্যের ছন্দ বুঝিয়ে দিলেন। আর গদ্যভাষাকে সুস্পষ্ট করার পথও তিনি দেখিয়ে দিলেন। দাড়ি, কমা, সেমিকোলন ইত্যাদি তিনি এমনভাবে ব্যবহার করলেন যাতে গদ্য পড়তে আমাদের কোনাে অসুবিধা না হয়। বেতাল পঞ্চবিংশতি, শকুন্তলা, সীতার বনবাস, ভ্রান্তি বিলাস ইত্যাদি তাঁর রচনা। এই রচনাগুলাের গদ্যভাষা খুব সুন্দর, তবে এই ভাষা আরাে সুন্দর হয়েছে বিরামচিহ্ন ব্যবহারের গুণে।

বিদ্যাসাগর ইংরেজি রচনারীতির সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। ইংরেজি গদ্যের বিরাম চিহ্ন ব্যবহারের অনুসরণে তিনি বাংলা গদ্যে এগুলাে ব্যবহার করেন। বিদ্যাসাগরের পরে বাংলা সাহিত্যে আরও বড় বড় গদ্য লেখকের জন্ম হয়েছে। যেমন- বঙ্কিম চন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, প্রমথ চৌধুরী, মীর মশাররফ হােসেন, কাজী আবদুল ওদুদ, অন্নদাশঙ্কর রায়, বুদ্ধদেব বসু, সৈয়দ মুজতবা আলী প্রমুখ। এঁদের হাতে বাংলা গদ্যে বিরাম চিহ্ন ব্যবহারের নিয়ম-কানুন আরাে সুদৃঢ় যেমন হয়েছে, তেমনি বিচিত্রও হয়েছে। বিদ্যাসাগরের আমলে বিরামচিহ্ন নিয়ে প্রচুর চিন্তা-ভাবনা করতে হয়েছিল। বিদ্যাসাগর বাংলা সাহিত্যে নতুন গতি সঞ্চার করেন বিরাম চিহ্ন ব্যবহারের মাধ্যমে।

1 thought on “বিরাম চিহ্ন ব্যবহারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ভূমিকা আলোচনা কর”

  1. Pingback: বাংলা ভাষার ইতিহাস ও ব্যবহারিক বাংলা সাজেসন্স | Cholo Shekhe

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top