‘বাংলা সংস্কৃতের দুহিতা’- সংক্ষেপে লেখ
ভাষার উৎপত্তি অনেকাংশে অনুমাননির্ভর বিশ্লেষণ হয়। যেসব তথ্যপ্রমাণ তুলে ধরে ভাষার কাল বিচার করা হয় সেখানে কিছু অতীতের ভাষার অনেক কিছু অস্পষ্ট থাকে। বাংলা ভাষার উৎস নির্ণয়ের ক্ষেত্রে নানা মতভেদ লক্ষ করা যায়।
ড. রফিকুল ইসলামের মতে- ‘ভাষা পৃথিবীর মধ্যেই এক আশ্চর্য পৃথিবী’। কারণ ভাষার কোন নির্দিষ্ট ভৌগোলিক, ধর্মীয় বা জাতীয় সীমারেখা নেই। একই ভাষা বিভিন্ন দেশের, বিভিন্ন ধর্মের, বিভিন্ন জাতির মাতৃভাষা হতে পারে। আবার কেবল একটি দেশের, একটি ধর্মের, একটি মানুষের ভাষাও হতে পারে।
দৃষ্টিভঙ্গিগত ও ঐতিহাসিক দিক থেকে বাংলা ভাষার উৎপত্তি বিষয়ে মতদ্বৈততার পরিচয় পাওয়া যায়। সংস্কৃত ভাষার সঙ্গে বাংলা ভাষার সম্পর্ক নিয়ে বিস্তৃত মতবাদ রয়েছে। সংস্কৃত পণ্ডিতগণ মনে করেন- ‘বাংলা সংস্কৃতের দুহিতা’ ।তারা মনে করেন-বাংলা ভাষার উৎপত্তি হয়েছে সংস্কৃত ভাষা থেকে।সংস্কৃতের সন্তান বলে বাংলাকে অভিহিত করলেও এটির পক্ষে-বিপক্ষে মতবাদ রয়েছে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী অষ্টম জাতীয় সাহিত্য সম্মেলনে বাংলা ভাষার বিবর্তনে সংস্কৃত ভাষার সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে কিছু মতামত উপস্থাপন করেন।
সংস্কৃতের সঙ্গে বাংলা ভাষার সম্পর্ক অনেক দূর। কারণ ভাষা প্রবাহের মধ্যে অপভ্রংশ এবং প্রাকৃত স্তরের যুগ দেখি। সংস্কৃত কেবল প্রাকৃত যুগের একটি সাহিত্যিক ভাষা। ব্রাহ্মণ্য সমাজে এই ভাষার প্রচার থাকলেও জনসাধারণের মধ্যে এর ব্যবহার ছিল না। সুতরাং সংস্কৃত নামে কোন যুগই সৃষ্টি হয়নি। প্রাকৃতের পূর্বে প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষার যুগ ছিল। ব্রাহ্মণ্য সমাজ বহির্ভূত জনসাধারণের মুখের ভাষা ছিল আদিম প্রাকৃত।সংস্কৃত ভাষাতে কোনো মানুষ কথা বলতো না এটি ছিল মূলত লেখার ভাষা।
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ প্রচলিত কিছু শব্দের উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন যে, এসব শব্দ সরাসরি সংস্কৃত থেকে বাংলায় আসেনি।বাংলা শব্দ যেমন- আমি,তুমি,মা,বাবা,হাত,পা এ শব্দের সংস্কৃত প্রতিশব্দ ছিল- আম্মদ,যুম্মদ,মাতা,পিতা,ভগিনী,হস্ত,পদ।স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে সংস্কৃত শব্দ গুলোর সাথে বাংলা শব্দের খুবএকটা কোন মিল নেই।বাংলাতে এ শব্দগুলো প্রাকৃত স্তরের মধ্য দিয়ে পরিবর্তীত হয়ে বাংলায় এসেছে।প্রাকৃত স্তরে এ শব্দের রূপ ছিল আম্মে, তুম্মে, মা-আ, বাপপ, বহিনী, হথু, পা-অ। প্রাকৃত স্তরের এই শব্দগুলো পরিবর্তিত হয়ে বাংলা ভাষায় এসেছে।
প্রকৃত পক্ষে বাংলা ভাষার সাথে সংস্কৃত ভাষার প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই বললেই চলে।সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে কিছু সংস্কৃত শব্দ বাংলা ভাষায় ব্যবহার হচ্ছে একথা সত্য তবে তার উপর ভিত্তি করে বাংলা ভাষাকে সংস্কৃতের দুহিতা বলা যাবে না।
Pingback: বাংলা ভাষার ইতিহাস ও ব্যবহারিক বাংলা সাজেসন্স | Cholo Shekhe