জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি

Spread the love

জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি

 বা, জলবায়ু পরিবর্তন ও বাংলাদেশে এর প্রভাব

 

ভূমিকা- এই পৃথিবীতে মানুষের টিকে থাকার জন্য পরিবেশ সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বসবাস উপযোগী পরিবেশ বিনষ্ট হলে মানুষের অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়বে। একবিংশ  শতাব্দীতে এসে জলবায়ু পরিবর্তন মানুষের বিবেককে জাগ্রত করছে। একের পর এক শিল্প-কলকারখানার  বৃদ্ধি পৃথিবীর তাপমাত্রা ও জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। সমগ্র বিশ্ব মারাত্মক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে। পৃথিবীর প্রতিটি দেশের জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কু-ফল ভোগ করছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য একের পর এক বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, সাইক্লোন আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায়  আতঙ্ক বৃদ্ধি পাচ্ছে। পৃথিবী আগামী দিনে মানুষের বসবাস উপযোগী থাকবে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো একের পর এক বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধের উপায় সম্পর্কে বিশ্ব সম্মেলনে জোর দাবি জানাচ্ছে। অপরিকল্পিত ভাবে প্রকৃতি ব্যবহারের ফল স্বরূপ জলবায়ু পরিবর্তন ঘটেছে এবং তার প্রভাব মানুষের জীবন যাপনের  উপর ইতোমধ্যে পড়েছে।

 

আবহাওয়া ও জলবায়ুর ধারণা- পৃথিবীর একেক দেশে একেক রকম আবহাওয়া বিরাজ করে। প্রতিটি দেশের অবস্থান  অনুসারে তাপমাত্রা,বায়ুপ্রবাহ, বৃষ্টিপাত, বাতাসের আদ্রতা ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে।তাই আমরা লক্ষ্য করি যখন বাংলাদেশের শীত শুরু হয় ঠিক তখন অস্ট্রেলিয়ার উপমহাদেশের দেশসমূহে গরমের তীব্রতা বাড়তে থাকে। আবহাওয়া বলতে কোন একটি অঞ্চলের অল্প কিছু দিনের তাপমাত্রা বিশেষত বায়ুপ্রবাহ, বৃষ্টিপাত ও বাতাসের আর্দ্রতার গড় পরিমাণ  বুঝায়। জলবায়ু বলতে কোন অঞ্চলের দীর্ঘসময়ের ( ২৫ থেকে ৩০ বছরের) আবহাওয়ার  গড় বোঝায়। 

 

জলবায়ু পরিবর্তনের স্বরূপ – বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কার আমাদের জীবনকে একের পর এক সহজ করেছে কিন্তু এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়েছে পরিবেশের উপর। পরিবেশে আজ ছড়িয়ে পড়েছে বিষাক্ত গ্যাস ও ক্ষতিকর আবর্জনা।  আজকের পৃথিবীতে  বিজ্ঞানের সফলতার পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তন  মানুষের দুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিল্প কারখানা স্থাপন, একের পর এক বনভূমি উজাড় হয়ে যাওয়া, দূষণ ও নগরায়নের ফলে আবহাওয়ায় একটি দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব পড়েছে। আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলেই মানুষকে নানামুখী বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। সার্বিক বিষয় বিবেচনা করলে দেখা যায় পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটেছে।  পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি হলে তাকে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বলা হয়।  বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বৃদ্ধির ফলে বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিচ্ছে।

 

জলবায়ু পরিবর্তনের বর্তমান অবস্থা – জলবায়ু পরিবর্তনের বর্তমান অবস্থা অত্যন্ত আশঙ্কাজনক। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা তাদের একটি গবেষণায় জানিয়েছেন যদি  সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১  মিটার বেড়ে যায় তাহলে বাংলাদেশের মতো উপকূলীয় দেশের ১৭.৫  শতাংশ সমভূমি সমুদ্র গর্ভে চলে যাবে। আইপিসিসি তাদের গবেষণায় জানিয়েছে ২০১০ সালের তুলনায় ২০৩০ সাল পর্যন্ত কার্বন নিঃসরণের হার ৪৫ শতাংশ কমাতে হবে।গবেষকদের মতে গত ১০০ বছরে পৃথিবীর তাপমাত্রা প্রায় ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমান সময়ে ইউরোপ-আমেরিকা এশিয়ার দেশসমূহে ব্যাপক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ।  বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে জলবায়ু পরিবর্তন হয়েছে। 

 

বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ – পরিবেশের উপর মানুষ অতিমাত্রায় প্রভাব বিস্তার করার ফলে প্রকৃতি নিজেই এখন প্রতিশোধ নিতে শুরু করেছে। শিল্প উন্নয়নের নামে প্রতিদিন বনাঞ্চল ধ্বংস করা হচ্ছে ফলে বায়ুমন্ডলে কার্বন- ডাই- অক্সাইডের পরিমাণ দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। দিনের-পর-দিন বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইড, মিথেন, ক্লোরোফ্লোরো কার্বন এর পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সূর্যের তাপ যে পরিমাণ পৃথিবীতে আসে  তার কিছু অংশ পৃথিবীতে থাকে আর বেশিরভাগ অংশই আবার ফিরে যায়। বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর গ্যাস বৃদ্ধির ফলে বায়ুমণ্ডল থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণ  সূর্যের তাপ বের হতে পারছে না। বায়ুমণ্ডলের  বাইরের দিকে যে ওজোন স্তর পৃথিবীকে সুরক্ষা দিয়ে থাকে সেটাই আস্তে আস্তে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। সুরক্ষা বলয় ক্ষয় হওয়ার কারণে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি সরাসরি পৃথিবীতে চলে আসছে। আইপিসিসির মতে গত শতাব্দীতে মিথেনের পরিমাণ বেড়েছে ১০০%, নাইট্রাস অক্সাইডের পরিমাণ বেড়েছে ১৯%, কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়েছে ২৪.৮৭ % । বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন গ্যাস বৃদ্ধির ফলে সূর্যের তাপ পৃথিবীতে আটকে পড়েছে ফলে পৃথিবীর  উষ্ণতা  দিনের পর দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য অনেকাংশে শিল্প উন্নত দেশসমূহ দায়ী। পরিবেশবাদীরা বিভিন্ন সময় আন্দোলন-সংগ্রাম প্রতিবাদ জানালেও জলবায়ু রক্ষায় কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণে উন্নত বিশ্ব একেবারেই উদাসীন।

 

জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাব – প্রকৃতির সঙ্গে আমরা যেমন ব্যবহার করব প্রকৃতি ও ঠিক তেমনি আমাদের সঙ্গে ব্যবহার করবে। প্রকৃতিকে নিজের মত থাকতে না দিয়ে আমাদের মতো করে  ব্যবহার করতে চেয়েছি। পৃথিবীর বিভিন্ন দিকে তাকালে দেখতে পাওয়া যায় জলবায়ু পরিবর্তন প্রকৃতিতে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। আন্টার্টিকা মহাদেশের বরফ দ্রুত গলে যাচ্ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের পানির পরিমাণ বেড়ে গিয়ে সমভূমি প্লাবিত হচ্ছে। সমুদ্রের লোনা পানি ফসলি জমিতে প্রবেশ করার কারণে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। গবেষকরা দাবি করছেন জলবায়ু পরিবর্তনেরে এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে প্রায় ১০ লাখ প্রজাতি বিলুপ্তির মুখে পড়বে।দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপ বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি রোধে কার্যকরী পদক্ষেপ এর জন্য ২০০৯ সালে পানির নিচে  সভা করে বিশ্ব সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আর্কষণ করেছিলেন। নেপালের প্রধানমন্ত্রী হিমালয়ের পাদদেশে মন্ত্রিসভার  বৈঠক করেছিলেন। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের বিরূপ প্রতিক্রিয়া সমগ্র পৃথিবীতে পড়তে শুরু করেছে।চীন, ইন্দোনেশিয়া, ফিজি, মালদ্বীপ, নেপাল, বাংলাদেশ, ফিলিপাইনসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের  মানুষ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, অষ্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে দাবানল ছড়িয়ে পড়ছে বছরের যে কোনো সময়ে।

 

সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি – দিনের-পর-দিন সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। উত্তরের বরফ যত বেশি গলে যাবে ততই সমুদ্রের পানির পরিমাণ বেড়ে যাবে। গবেষকরা দাবি করেছেন বাংলাদেশের কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত এর উচ্চতা প্রতিবছর ৭.৮ মিমি করে  বৃদ্ধি পাচ্ছে। ক্রমবর্ধমান উষ্ণায়ন বৃদ্ধির ফলে দ্বীপ জেলা ভোলার প্রায় এক চতুর্থাংশ ডুবে গেছে গত এক দশকে। ধারণা করা হচ্ছে  ২১০০ সাল নাগাদ  পৃথিবীর সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এক মিটার বৃদ্ধি পাবে।

 

মরুকরণ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস- জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে প্রথম আঘাতটি পড়ছে বনাঞ্চলে। একের পর এক বনভূমি বিলীন হওয়ার কারণে উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে ফলে তার প্রভাব পড়ছে অন্য  বনভূমির উপর। স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে প্রায় ৮২ শতাংশ কমে গেছে।বাস্তুতন্ত্র হারিয়ে বিলুপ্তির পথে প্রায় ১ মিলিয়ন প্রাণী।পৃথিবীতে প্রতি তিনটি প্রজাতির মধ্যে দুটি প্রজাতি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বিশেষ করে সমুদ্র তলদেশের জীব বৈচিত্র্য বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। বিভিন্ন প্রজাতির কীটপতঙ্গ বিলুপ্ত হওয়ার কারণে পরাগায়নে সমস্যা দেখা দিচ্ছে ফলে হ্রাস পাচ্ছে খাদ্য উৎপাদন। বিশ্বের প্রায় ৭০ শতাংশ ভূমি মরু কবলিত হয়ে পড়েছে ।সাম্প্রতিক সময়ের প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিশেষ করে আইলা,সিডর, নার্গিস, আম্ফান পরিবেশ বিজ্ঞানীদের বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। মরুকরণের ভয়াবহতা সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে প্রতি বছর ১৭ জুন  বিশ্ব  মরুকরণ ও খরা দিবস পালিত হয়ে আসছে। 

 

নদ নদীর প্রবাহ হ্রাস – জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে নদনদী মুক্ত নয়। পৃথিবীর অনেক বড় বড় নদী তার স্বরূপ হারিয়েছে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে। বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাব বাংলাদেশের রাজশাহী অঞ্চলের পদ্মা নদীতেও পড়েছে। পৃথিবীর দীর্ঘতম নদী নীলনদ ইথিওপিয়া ও মিশর অংশে তার স্বাভাবিকতা বিনষ্ট হয়েছে। দক্ষিণ আমেরিকার দেশ আমাজানের প্রবাহ দিনের পর দিন হ্রাস পাচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশের অনেক নদী মৃতপ্রায়। বাংলাদেশের নদ-নদীর পরিমাণ ছিল প্রায় ৭০০ যা এখন সরকারি হিসেবে দাঁড়িয়েছে ৩৫০ এর কাছাকাছি। 

 

বন্যা -খরা বৃদ্ধি – জলবায়ু পরিবর্তন ও মানুষের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের কারণে প্রকৃতি বিরূপ আচরণ করতে শুরু করেছে ফলে দিনের পর দিন বন্যা খরা বৃদ্ধি পাচ্ছে।দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল খরা কবলিত হয়ে পড়ছে। আফ্রিকা মহাদেশের দেশসমূহ বিশেষত দক্ষিণ সুদান, কঙ্গো, মালি, পশ্চিম আফ্রিকা সহ প্রভৃতি দেশে প্রচন্ড খরার কারণে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে ফলে খাদ্য ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে চীন, ভারত, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া সহ বেশ কিছু দেশে ব্যাপক হারে বন্যা দেখা দিয়েছে। বছরের যে কোনো সময়ে  বন্যার সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে। ২০২০ সালের বন্যায় বাংলাদেশের প্রায় ৩০ শতাংশ ডুবে গিয়েছিল যা জেলার হিসাবে প্রায় ২৫ টি জেলা প্লাবিত হয়েছিল।

 

নিম্নভূমি প্লাবন – সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা যত বৃদ্ধি পাবে নিম্নভূমি ততই প্লাবিত হবে। এন্টার্কটিকা মহাদেশের বরফ গলতে শুরু করার কারণে সমুদ্রের পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমুদ্রের পানি বৃদ্ধির ফলে নিম্নভূমি প্লাবিত হচ্ছে। বাংলাদেশের নিম্নভূমি প্লাবিত হওয়ার ফলে যে পরিমাণ সম্পদের ক্ষতি হয়েছে তার আনুমানিক মূল্য প্রায় ২৪২ বিলিয়ন টাকা।মালদ্বীপ, ইন্দোনেশিয়ার মতো দ্বীপ প্রধান দেশ সব থেকে বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা যত বৃদ্ধি পাবে ততোই নিম্নভূমি প্লাবনের আশঙ্কা বেড়ে যাবে। প্রতিনিয়ত নিম্নভূমি প্লাবনের ফলে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬৫ শতাংশ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছে।

 

মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি – সমুদ্রের পানি বৃদ্ধির ফলে সমভূমি  প্লাবিত হচ্ছে। সমভূমিতে সমুদ্রের পানি প্রবেশ করার ফলে মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে ।মাটিতে লবণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কারণে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে এবং বনভূমি একের পর এক কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৫%  বসবাস করে সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলে। সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্ছতা ১০০সেমি বৃদ্ধি পেলে প্রায় ৩ কোটি  মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। গ্রীষ্মকালে লোনা পানি দেশের  অভ্যন্তরে প্রায় ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত নদীতে প্রবেশ করে। 

 

নদী ভাঙ্গন ও জলোচ্ছ্বাস বৃদ্ধি – ঝড়, বন্যা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষয় ক্ষতি হলেও অন্তত ভিটে মাটি থাকে কিন্তু নদী ভাঙ্গনের  শিকার হলে কিছুই থাকে না। নদীর এই ভাঙা-গড়ার খেলায় বিপর্যস্ত হয়  সাধারণ মানুষের জীবন। বাংলাদেশে গড়ে প্রতি বছর প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নদী ভাঙ্গনের শিকার হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকায় রয়েছে ১২০ টি উপজেলা এবং ছোট-বড় প্রায় ২১ টি শহর। জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে নদী ভাঙ্গনের পাশাপাশি জলোচ্ছ্বাস বৃদ্ধি পেয়েছে। চীন, ভারত, পাকিস্তান, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সময়-অসময়ে জলোচ্ছ্বাস সৃষ্টি হচ্ছে। আফ্রিকা ও জাপানে জলোচ্ছ্বাসে ২০১৯ সালে মৃত্যুবরণ করেছে ১২ হাজার মানুষ। 

 

জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ – সময়ের সাথে সাথে বদলে যাচ্ছে প্রকৃতি, বদলে যাচ্ছে মানুষের জীবনযাত্রা। প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে প্রতিনিয়ত মানুষকে বেঁচে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত হতে হচ্ছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করা আরো বেশী কষ্টসাধ্য। সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ ‘আম্ফান’ দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জীবনকে আরো বেশি বিপর্যয়ে ফেলেছে। বর্ষা মৌসুমে প্লাবিত হচ্ছে নদী তীরবর্তী অঞ্চল।কুড়িগ্রাম,গাইবান্ধা,সিরাজগঞ্জ,মৌলভীবাজার, শরীয়তপুর,  চাঁদপুর,নোয়াখালী,ফেনী,ফরিদপুরসহ  বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা প্লাবিত হচ্ছে। প্রতিনিয়ত দেশের মানুষকে একটি কঠিন বাস্তবতার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। বাংলাদেশে ক্রমান্বয়ে শীতকালের ব্যাপ্তি ও শীতের তীব্রতা দুইই কমে আসছে।উপকূলের চাষিরা সব থেকে বেশি বিপর্যস্ত। সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী অঞ্চলে লোনা পানি ঢুকে ফসলের জমি নষ্ট করে দিচ্ছে।  ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস এর পরিমাণ পূর্বের তুলনায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনেক বেশি বেড়ে গেছে। যশোরের ভবদাহ বিলের পানি নিষ্কাশিত না হওয়রে ফলে  মানুষ দীর্ঘদিন ধরে জলাবদ্ধ অবস্থায় বসবাস করছে। ইতিমধ্যে নদীর অনেক মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বর্ষা মৌসুমে হঠাৎ করে শিলাবৃষ্টি শুরু হচ্ছে যা কৃষকের ফসল ধান, তরমুজ, কলা, পেঁপে  ব্যাপক ক্ষতির করছে। বিগত ২৫ বছরের আবহাওয়ার উপাত্ত থেকে দেখা যায় যে, বাংলাদেশের গড় উষ্ণতা তেমন বাড়েনি। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৩০ সন নাগাদ গড় তাপমাত্রা ১.০ ডিগ্রি, ২০৫০ সনে ১.৪ ডিগ্রি এবং ২১০০ সনে ২.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যেতে পারে। সাম্প্রতিক কালে তাপমাত্রা না বাড়লেও উষ্ণ ও শৈত্যপ্রবাহের মাত্রা বেড়েছে। 

 

বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধে শিল্পোন্নত দেশের  করণীয় – জলবায়ু  পরিবর্তনের ফলে প্রকৃতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির দায় শিল্পোন্নত দেশ কখনোই অস্বীকার করতে পারে না। যে সব দেশে বৈশ্বিক উষ্ণতার কুফল ভোগ করার সম্ভাবনা রয়েছে সেসব দেশকে  অবশ্যই ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। শিল্পোন্নত দেশে কার্বন অতিমাত্রায় নির্গত না হয় এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পরিবেশ বান্ধব  কাঁচামাল ব্যবহার করতে হবে। পরিবেশের ক্ষতি করে না এমন পণ্য উৎপাদন করতে হবে। আর্থিক বিষয়কে প্রাধান্য না দিয়ে মানুষের জীবনকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, জাপান, ফ্রান্স, রাশিয়া, ইতালি, কানাডাসহ পৃথিবীর শিল্পোন্নত দেশ বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য দায়ী।  শিল্পোন্নত দেশ বর্তমানে যেভাবে কার্বন নিঃসরণ করছে এভাবেই যদি বৃদ্ধি পেতে থাকে তাহলে ২০৩০ সাল পর্যন্ত বায়ুমন্ডলে ৬০ শতাংশ কার্বন বৃদ্ধি পাবে। উন্নত বিশ্বকে পরিবেশ বান্ধব প্রযুক্তি আবিষ্কার করতে হবে। গ্রীন হাউজ গ্যাস নির্গমন কমানোর ক্ষেত্রে একটি লক্ষ্য ঠিক করতে হবে।বাস্তবতা হল- উন্নত দেশ সমূহ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্থ দেশসমূহকে ক্ষতিপূরণ দিতে যেমন অনিহা তেমনি ভাবে কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করতে অনাগ্রহী।

 

উন্নয়নশীল দেশের করণীয় –  উন্নয়নশীল দেশ চেষ্টা করে সবসময় উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার জন্য। উন্নত বিশ্ব হিসেবে নিজেদের টিকিয়ে রাখতে হলে টেকসই উন্নয়ন প্রাধান্য দেওয়া উচিত। পরিবেশের জন্য মানানসই এমন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। যেসব পণ্য উৎপাদন করলে পরিবেশের ক্ষতি হতে পারে সেগুলোর বিকল্প চিন্তা করতে হবে। কার্বন নিঃসরণকারী শিল্পোন্নত দেশকে  আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মাধ্যমে চাপ প্রয়োগ করতে হবে। অনুন্নত দেশের প্রতিনিধি হিসেবে উন্নয়নশীল দেশ বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধে  সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করতে পারে।দূষণ হীন প্রযুক্তি আবিষ্কার করার পাশাপাশি পরিবেশ বান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে।

 

বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধে আন্তর্জাতিক সংস্থার ভূমিকা- জলবায়ু পরিবর্তন ইতোমধ্যে বিশ্ব রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। ১৯৭২ সালে জাতীয় পরিবেশ সম্মেলন প্রথম অনুষ্ঠিত হয়। এরপর জলবায়ু বিষয়ক একাধিক ‘ধরিত্রী সম্মেলন’ অনুষ্ঠিত হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে অর্থ্যাৎ ২০১৭ সালে ইউএনএফসিসিসি- ১৯২ টি দেশের অংশগ্রহণে জার্মানির শহর বনে COP-23 জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৯ সালে মাদ্রিদ ও চিলিতে COP-25 সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তবে এ সম্মেলনে পরিবেশবাদীদের উল্লেখযোগ্য কোনো দাবি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় নি।

 

উপসংহার- আজকের বিশ্বের প্রধান সংকট জলবায়ু পরিবর্তন। এর ফলে পরিবেশের ভারসাম্য একের পর এক নষ্ট হয়ে যাচ্ছে নষ্ট হচ্ছে জীব বৈচিত্র্য। বিশেষ করে কৃষি প্রধান দেশ সমূহের জন্য বৈশ্বিক উষ্ণতা  অত্যন্ত ভয়ঙ্কর বার্তা নিয়ে আসছে। পৃথিবীতে একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়েই যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতার ক্ষেত্রে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। জলবায়ু সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত সমূহকে গুরুত্বের সঙ্গে বাস্তবায়নের চেষ্টা করতে হবে। পরিবেশের  ক্ষতি হয় এমন কোন শিল্প কলকারখানা তৈরি থেকে বিরত থাকতে হবে। পৃথিবীকে বাস যোগ্য রাখতে হলে বৈশ্বিক উষ্ণতা হ্রাস করার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top