বাংলা উপভাষার পরিচয় দাও

Spread the love

বাংলা উপভাষার পরিচয় দাও

উপভাষা হচ্ছে কোন বিশেষ ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর ব্যবহৃত ভাষা। মনীষী ম্যাক্সমুলার বলেছেন, The real and natural life of language is in its dialects. অর্থাৎ ভাষার যথার্থ ও স্বাভাবিক জীবন মূলত উপভাষায়। সাধারণ লােকেরা প্রাত্যহিক জীবনের সকল প্রয়ােজন মেটাতে উপভাষাই ব্যবহার করে। বিশেষ করে ক্ষুদ্র গণ্ডি বা পরিসরের সুবিধার জন্য সাধারণ মানুষ বিশেষ ধরণের উচ্চারণরীতি ও শব্দ সম্পদ ব্যবহার করে থাকে। মূল ভাষার মান্য ও আদর্শ রূপের বাইরে বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অঞ্চলের উচ্চারণরীতি, শব্দ প্রয়ােগ ও অর্থগ্রাহ্যতার সাপেক্ষে যে বিশেষ ভাষারীতি গড়ে ওঠে তাই উপভাষা। সেজন্য বলা যায় উপভাষার মধ্যে ভাষার সত্যিকারের স্বাভাবিক প্রাণ-প্রবাহের পরিচয় পাওয়া যায়।

বাংলার বাইরে বিহার, উড়িষ্যা এবং আসামের কোন কোন অংশে বাংলা ভাষা প্রচলিত। স্থানীয় কারণ ছাড়াও সামাজিক কারণেও ভাষার রূপভেদ লক্ষণীয়। এমন রূপভেদ লক্ষযােগ্য সিলেটের ভাষার সাথে কোলকাতার ভাষার । অঞ্চলগত ব্যবধানের কারণে যেমন ভাষার রূপগত পার্থক্য দেখা যায়, তেমনি পেশাগত ভিন্নতার কারণে ভাষার রূপগত পরিবর্তনও ঘটে। তবে কোন স্থানের খাঁটি উপভাষা জানতে হলে সে স্থানের অশিক্ষিত সাধারণ জনতার ভাষাকে বিচার করতে হবে। একটি ভাষিক অঞ্চলের সীমানা সংলগ্ন আর একটি ভাষিক অঞ্চলের সন্ধিস্থলে উভয় ভাষার মধ্যবর্তী একটি উপভাষার সৃষ্টি হয় । এ রূপটিকে দুই ভাষারই উপভাষা রূপে গণ্য করা যায়। বাংলায় উপভাষাগুলোকে সঠিকভবে জরিপ করে তার বৈশিষ্ট্য লিপিবদ্ধ করা যায় নি। ড. সুকুমার সেন বাংলা উপভাষার বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে পাঁচটি শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন-

১। রাঢ়ী: রাঢ় অঞ্চল অর্থাৎ ভাগীরথীর দুই তীরবর্তী অঞ্চলের মৌখিক ভাষা : মধ্য পশ্চিমবঙ্গ।
২। ঝাড়খণ্ডী: দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গের কথ্য ভাষা।
৩। বরেন্দ্র: উত্তর মধ্যবঙ্গের উপভাষা।
৪। বাঙালা: পূর্ববঙ্গের উপভাষা।
৫। কামরূপী: উত্তর পূর্ববঙ্গ, শ্রীহট্ট অঞ্চলের উপভাষা।

এই উপভাষাসমূহের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে। উপভাষা আলােচনা সাপেক্ষে প্রত্যেকটির ধ্বনিতাত্ত্বিক ও রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হল :
রাঢ়ী উপভাষা :

ক) অ-কার  ও কার রূপে উচ্চারণের প্রবণতা। যেমন- অতুল> ওতুল; বন>বােন, মধু>মােধু।
খ) আনুনাসিক স্বর পূর্ণভাবে রক্ষিত হয় । যেমন- চাঁদ, কাঁটা, বাঁধ ইত্যাদি ‘স্থানে ‘ন’ এর উচ্চারণ ঘটে। যেমন- লুচি>নুচি, লেপ>নেপ, লাল>নাল ।
গ) ল স্থানে ন উচ্চারণ হয়। যেমন- লাল>নাল, লেপ>নেপ।
ঘ) ‘ শ’, ষ, স স্থানে (যুক্তব্যঞ্জন বাদে) ‘শ’ এর উচ্চারণ। যেমন-আশু>আসু, শশী> সসী।
ছ) স্বর মধ্যবর্তী ‘হ’ দূর্বল, ফলে এটির লােপ ঘটে । যেমন- তাহার>তার, কহে>কয় । পশ্চিমা, রাঢ়ীতে আদি ‘হ’ রক্ষিত হয়। যেমন- হবে।
জ) কর্মকারকে ও সম্প্রদানে কে বিভক্তির ব্যবহার ।
ঝ) কর্মকারকে বহুবচনের বিভক্তি ‘দের’।
ঞ) অধিকরণ কারকে ‘তে’ বিভক্তির ব্যবহার।

ঝাড়খণ্ড ভাষা :

ড.সুকুমার সেন এই উপভাষার নামকরণ করেছেন ঝাড়খণ্ডী। এ ভাষা মােটামুটি রাঢ়ীর মতো। কোন কোন ক্ষেত্রে ওড়িয়ার সাথে এর সাদৃশ্য লক্ষণীয়। ঝাড়খন্ডীর বিশেষ কয়েকটি বৈশিষ্ট্য হল-

ক) অনুনাসিক ধ্বনির ব্যবহার অধিক। যেমন- চাঁ,হাঁসছে ইত্যাদি।
খ) অনুসর্গহীন সম্প্রদান কারক। যেমন-জলকে চল, ঘাসকে গেলছে, পানিতে আসে।
গ) নাম ধাতুর বহুল ব্যবহার।যেমন- বই,হাত।
ঘ) উত্তম পুরুষ সর্বনাম মুই/আমি, বহুবচনে আমার/হামরা। মুখ্য ও গৌণ কর্মে- মাে-> আমা ,তু-মােকে/আমাকে দাও।

বরেন্দ্রী উপভাষা :

ক) স্বরধ্বনির ক্ষেত্রে রাঢ়ীর সঙ্গে প্রায় অভিন্ন।
খ) সানুনাসিক স্বরধ্বনি রক্ষিত হয়েছে।
গ) শব্দের আদিতে ঘোষধ্বনির মহাপ্রাণতা রচিত হয়েছে।
ঘ) শ্বাসাঘাতের নির্দিষ্ট স্থান নেই।
ঙ) পূর্ববঙ্গীয় উপভাষার প্রভাবে জ ধ্বনি কখনাে ‘য’ (জ) রূপে উচ্চারিত হয়।
চ) শব্দের আদিতে র এর আগম লােপ পায়। যেমন- রস>অস: বামবাবু> আমবাবু।
ছ) শব্দ ও ধাতুরূপে এ উপভাষার সঙ্গে বাঢ়ী উপভাষার সাদৃশ্য আছে। অধিকরণ কারকে ‘ত’ বিভক্তির প্রয়ােগ। অতীতকালে উত্তম পুরুষে- নাম বিভক্তি। জ) প্রত্যন্ত অঞ্চলে (গৌড়) শ, ষ, স এর স্থলে ‘স’ এর উচ্চারণ।

বাঙালা বা বঙ্গীয় উপভাষা :

ক) অপিনিহিতির সার্বিক প্রয়োগ রক্ষিত হয়। যেমন- করিয়া>কইরা, চারি>চাইর ইত্যাদি।
খ) য-ফলা ও সংযুক্ত ব্যঞ্জনে অপিনিহিতির মধ্যে স্বরাগোম হয় । যেমন- সত্য-সইও।
গ) সংবৃত এ; বিবৃত এ>এ্যা তে পরিণত হয়। যেমন-তেল> ত্যাল, দেশ>দ্যাশ, কেন >ক্যান।
ঘ) ও কারের উচ্চারণ অনেকটা সংবৃত (উ-এর মত)। যেমন- চোর-চুর।
ঙ) স্বর ধ্বনিতে নাসিক্যতা বজায় নেই। আনুনাসিক : চান্দ, কান্দে, (চাঁদ,কাঁদে)।
চ) শ্বাসাঘাতের কোন নির্দিষ্ট স্থান নেই।
ছ) মহাপ্রাণ ঘোষ ধ্বনির মহাপ্রাণতা লােপ পেয়ে দ, ধ, ভ স্থানে গ, ন, র হয় ।
জ) তালব্য ধ্বনির দন্ত্য তালব্য ঘৃষ্ট ধ্বনি রূপে উচ্চারিত হয়। চ-ৎস, ছ-স।
ঝ) শ,স, ষ এর হ রূপে উচ্চারণ রীতি। যেমন-শালা > হালা, সে>হে, শুনছি>হুনছি।
ঞ) ড়, ঢ় এর র রূপে উচ্চারণ রীতি। যেমন- বাড়ী>বারি, আষাঢ়>আষার।

কামরূপী উপভাষার বৈশিষ্ট্য :

কামরূপী ও বরেন্দ্রীকে একত্রে উদীচ্য উপভাষা বলা হয়। কামরূপী বরেন্দ্র ও বাঙ্গালার মাঝামাঝি। কোন কোন বিষয়ে কামরূপী উত্তরবঙ্গের এবং কতক বিষয়ে তা পূর্ববঙ্গের উপভাষার কাছাকাছি। তবে বরেন্দ্রীর সঙ্গেই কামরূপীর মিল অধিক।

ক) ‘ও’ কারের উচ্চারণ অনেকটা সংবৃত। ও > উ; জ্যোতিষ > জুতিষ।
খ) অপিনিহিতির সীমিত প্রয়ােগ। যেমন- আজি, করিয়া, কিন্তু—আইজ, কইর‌্যা (বাঙ্গালা)।
গ) আদি ‘অ’ প্রায়শই শ্বাসাঘাতের ফলে ‘আ’ হয়। যথা-আসুখ; আনল, আতি ইত্যাদি।
ঘ) পদের আদিতে ‘অ’ ধ্বনি উচ্চারণে ‘উ’ হয়। যেমন-ডগা-ডুগা।
ঙ) পদ মধ্যবর্তী ‘প’ উষ্ম ধ্বনির ‘ফ’ রূপে উচ্চারিত হয়। আপদ-আফদ; আপনার-আফনার ।
চ) কখনও শব্দ মধ্যে ‘র’ ধ্বনির আগমন হয়। যেমন-সম্মান > সর্মান, সাহায্য > সাহার্য।
ছ) ভবিষ্যৎকালে ক্রিয়ায় ‘বাম’ প্রত্যয় হয় । যেমন-করবাম>করিব; খাইবাম > খাইব।

1 thought on “বাংলা উপভাষার পরিচয় দাও”

  1. Pingback: বাংলা ভাষার ইতিহাস ও ব্যবহারিক বাংলা সাজেসন্স | Cholo Shekhe

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top