বাংলা ভাষার প্রয়োগ ও অপপ্রয়োগ সম্পর্কে নাতিদীর্ঘ আলোচনা কর
পৃথিবীর অন্যান্য ভাষার ন্যায় বাংলা ভাষাও প্রবহমান নদীর মতাে নিরন্তর গতিতে বয়ে চলেছে। প্রায় দুই লক্ষ শব্দ নিয়ে বাংলা সচল রয়েছে। সচল আছে বলেই অন্যান্য ভাষা থেকে নতুন শব্দ প্রতিনিয়ত বাংলা ভাষায় গৃহীত হচ্ছে। হাজার বছরের পুরােনাে বাংলা ভাষা আমূল পরিবর্তিত হয়ে আধুনিক রূপ পরিগ্রহ করেছে। উনিশ শতকে নতুন ভাব ও বিষয় প্রকাশের ক্ষেত্রে দেশী-বিদেশী লেখকবৃন্দ তৎসম শব্দ প্রয়ােগে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বােধ করতেন। বাংলা ভাষায় মৌলিক শব্দের পাশাপাশি প্রচুর সাধিত শব্দ রয়েছে। মৌলিক শব্দের সঙ্গে উপসর্গ, বিভক্তি, পদাশ্রিত নির্দেশক, দ্বিরুক্তি শব্দ যুক্ত হয়ে কিছু শব্দ সাধিত হয়। আবার সন্ধি, সমাস, প্রত্যয়, পদান্তর যােগেও নতুন শব্দ গঠিত হয়। নতুন শব্দ সৃষ্টির সময় ভাষায় মূল শব্দের অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়। এ জাতীয় পরিবর্তনও বানানের ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। সুতরাং ভাষা তথা বানান শুদ্ধ করে লেখার জন্য শব্দের এ সব পরিবর্তন জানা একান্ত প্রয়ােজন।
খেয়ালখুশিমতাে শব্দ ব্যবহার পরিহার করে ভাষায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে অভিন্ন বানান রীতির প্রয়ােজনীয়তা দেখা দেয়। কিন্তু উনিশ শতকের আগে বানানের সঠিক নিয়ম বলতে কিছু ছিল না। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ক্ষেভে লিখেছিলেন, “পাঁচ কোটি বাঙালীর অধিকাংশই বানান ভুল করে।” আজ আমরা সকল বাঙালিই সম্ভবত কোন না কোন ট্র্যাডিশনের অনুবর্তী হয়ে কেবলই বানান ভুল করে চলেছি। সেকালে কেবল অ-তৎসম শব্দের বানানে শৃঙ্খলার অভাব ছিল, একালে প্রায় সকল বাংলা বানানে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে।”
যারা বাঙালি তাদের মায়ের ভাষা (মাতৃভাষা) বাংলা। আধুনিক ভাষা-বিজ্ঞানীদের মতে, বিশ্বের প্রায় ৩০ কোটি লােক বাংলা ভাষায় কথা বলেন । সুতরাং বাংলা ভাষা পৃথিবীর একটি অন্যতম বিশিষ্ট ভাষা । এর ব্যাপক ব্যবহারের সাথে সাথে দুঃখজনক যে বিষয়টি প্রায়শঃ নজরে পড়ে সেটি হল- বাংলা বানান ও উচ্চারণে চরম বিশৃঙ্খলা। শিল্প সাহিত্যের বাইরে বিজ্ঞাপনে, পােস্টারে, সাইনবাের্ডে, বেতার-টেলিভিশনে, সংবাদপত্রের পাতায়, অফিসিয়াল দৈনন্দিন কাজকর্মে এ জাতীয় ভুলের বা ভাষার অপপ্রয়ােগের নানা চিত্র আমরা প্রতিনিয়ত লক্ষ করি । বাংলা ভাষা প্রয়ােগের ক্ষেত্রে অপপ্রয়ােগ বা ভুলের যে নৈরাজ্য চলছে তাতে শুধু বাংলা ভাষার প্রতি অবহেলা বা ঔদাসীন্যই প্রকাশ পায় না, ভাষার নিয়ম-শৃঙ্খলা সম্পর্কে অজ্ঞতাও দৃষ্ট হয়। ভাষার শুদ্ধ প্রয়ােগ সম্পর্কে দক্ষতা ও যােগ্যতা অর্জনের জন্য প্রয়ােজন ব্যাকরণ-জ্ঞান, শব্দ ও বাক্যের অপপ্রয়ােগ সম্পর্কে বিশেষ ধারণা এবং সেগুলাে পরিহারে সতর্কতা ও সচেতনতার প্রয়াস। সর্বত্র ভাষার ব্যবহারে ভুল অপপ্রয়ােগ চলতে থাকলে ভাষার চলমান গতি বাধাপ্রাপ্ত হবে। তাই মুদ্রণ ও লেখায় ভাষার শুদ্ধ প্রয়ােগের ক্ষেত্রে ভুল বা ক্রটির চিহ্নিত করা দরকার। তাহলে শিক্ষার্থীসহ অন্যান্য শ্রেণিপেশার মানুষ ভাষার ভুল বা অপপ্রয়ােগ থেকে বিরত থাকতে সচেষ্ট হবে। ভুলের প্রধান ক্ষেত্রগুলাে নিচে উল্লেখ করা হল :
১. বর্ণের অশুদ্ধ বা বানানের অশুদ্ধি।
২. বাক্যে পদের/শব্দের অপপ্রয়ােগ।
৩. বাক্যে পদবিন্যাসজনীত বা পদক্রমের সমস্যা।
৪. শব্দের অর্থগত বিভ্রান্তি।
৫. সাধু ও চলিত ভাষারীতির মিশ্রণজনিত দোষ ।
১. বর্ণের অশুদ্ধি বা বানানের অশুদ্ধি : উচ্চারণ অসতর্কতার কারণে অনেক সময় বানান ভুল হয়ে থাকে। উচ্চারণে অজ্ঞতা এবং আঞ্চলিকতার প্রভাব থেকেই বানান ভুল হয়ে থাকে। বানানের নিয়ম। বানানের নিয়ম সম্পর্কে জানা না থাকলে বানান ভুল হতে পারে। ব্যাকরণের বিভিন্ন বিষয় যেমন- বর্ণশুদ্ধি, ণ-ত্ব ও ষ-ত্ব বিধান, সন্ধি, সমাস, লিঙ্গ, প্রত্যয়, বচন, বাহুল্য প্রয়ােগ, সাধু-চলিত রীতির ব্যবহার ভুল করলেই শব্দ ও বাক্য অশুদ্ধ বলে প্রমাণিত হবে ।
উদাহরণ-
উচ্চারণ ঘটিত ভুল : অত্যান্ত- (শুদ্ধ) অত্যন্ত, এতদ্বারা- (শুদ্ধ) এতদ্দ্বারা।
সন্ধিঘটিত ভুল : ইতিপূর্বে (শুদ্ধ) ইতঃপূর্বে, পক্ক-(শুদ্ধ) পক্ব।
ণ-ত্ব ও ষ-ত্ব ঘটিত ভুল : প্রাঙ্গন- (শুদ্ধ) প্রাঙ্গণ, অপরাহ্ন- (শুদ্ধ) অপরাহ্ণ।
বচন ঘটিত ভুল : বালকগণেরা (শুদ্ধ)- বালকগণ, বালকেরা, যাবতীয় প্রাণিবৃন্দ (শুদ্ধ) যাবতীয় প্রাণী।
সমাস ঘটিত ভুল : ছাগীদুগ্ধ- (শুদ্ধ) ছাগদুগ্ধ, প্রাণী হত্যা (শুদ্ধ) প্রাণিহত্যা ইত্যাদি।
২. বাক্যে পদের/শব্দের অপপ্রয়ােগ : শব্দের অর্থ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা না থাকলে বাক্যে শব্দের/পদের অপপ্রয়ােগ ঘটে। যেমন- উৎকর্ষতা- (শুদ্ধ) উৎকর্ষ/উৎকৃষ্টতা, দৈন্যতা-(শুদ্ধ) দীনতা/দৈন্য ইত্যাদি।
৩. বাক্যে পদবিন্যাসজনিত ক্রটি : ইচ্ছেমতাে বাক্যে এলােমেলাে পদসংস্থাপন করা যাবে না। শুদ্ধ বাক্যের জন্য প্রয়ােজন সুশৃঙ্খল পদবিন্যাস। বাক্যের গঠন সম্পর্কে প্রায়ােগিক ধারণা বা জ্ঞান না থাকলে বাক্যে পদবিন্যাসজনিত ক্রটি ঘটবে।
যেমন- ১. তিনি জনসভায় ভাষণ দিতে পারেন নি। কিন্তু সভায় লােক সমাগম হয় নি।
শুদ্ধ – তিনি জনসভায় ভাষণ দিতে পারেন নি; কারণ সভায় লােক সমাগম হয় নি।
২. প্রাপ্তির চিঠি দেখে তিনি অবাক হইলেন।
শুদ্ধ- প্রাপ্তির চিঠি দেখিয়া তিনি অবাক হইলেন।
৪. শব্দের অর্থগত বিভ্রান্তি : শব্দের অর্থগত বিভ্রান্তির কারণে অনেক সময় বাক্যে শব্দের অশুদ্ধ প্রয়ােগ ঘটে থাকে। যেমন-
৪০ সেরে হয় এক মন। (অশুদ্ধ)
৪০ সেরে হয় এক মণ। (শুদ্ধ)
আমাকে এক গ্লাস পাণি দাও। (অশুদ্ধ)
আমাকে এক গ্লাস পানি দাও। (শুদ্ধ)
৫. সাধু ও চলিত ভাষারীতির মিশ্রণজনিত ক্রটি : প্রমথ চৌধুরী বলেছিলেন, বিশ শতকে সাহিত্যশিল্পসহ সকল প্রচার মাধ্যমে চলিত গদ্যরীতির ব্যবহার প্রাধান্য পাবে। বাংলা ভাষায় একসময় একচেটিয়া সাধুভাষারীতির প্রচলন ছিল, কিন্তু কালের বিবর্তনে চলিত ভাষারীতি সে স্থান দখল করে নিয়েছে। লেখা ও মুদ্রণের ক্ষেত্রে এই দুই রীতির যে-কোন একটি রীতি অনুসরণ না করলে বিভ্রান্তি দেখা দেবে এবং ভাষা দুর্বল ও শিথিল হয়ে পড়বে।
মিশ্রিত : তাকে বাজারে যাইতে হবে।
সাধু : তাহাকে বাজারে যাইতে হইবে।
চলিত : তাকে বাজারে যেতে হবে ।
উক্ত বিষয়সমূহ লক্ষ করে লিখলে বাংলা বাক্য শুদ্ধ হবে। প্রতিমুহূর্তে আমাদের বাংলা লিখতে হলে বানান , অপপ্রয়োগ, লিঙ্গজনিত ভুল বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে।
Pingback: বাংলা ভাষার ইতিহাস ও ব্যবহারিক বাংলা সাজেসন্স | Cholo Shekhe