Spread the love

মহামারী করোনা ভাইরাসের সময়ের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করো বা, কভিড-১৯ এর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করো

সভ্যতার শুরু থেকেই মানবসমাজ ছুটে চলেছে সমৃদ্ধির উদ্দেশ্যে। সময়ের প্রেক্ষাপটে জ্ঞান-বিজ্ঞানের যেমন বিস্তার লাভ  করেছে তেমনি ভাবে মানুষ প্রয়োজনে একে অন্যের সঙ্গে ভাব বিনিময়ের মধ্য দিয়ে নিজেকে সমৃদ্ধ   করার চেষ্টা করেছে। গতিশীল জীবনের এ ধারাবাহিকতার মধ্যে ছেদ পড়েনি বিন্দুমাত্র। ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর চীনের উহান শহরে সংক্রমণ ঘটে নতুন ধরনের করোনাভাইরাসের যার প্রভাবে মানুষের চিরন্তন মেলামেশার অভ্যাস পরিহার করে বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন করতে বাধ্য হতে হয়। সর্দি, কাশি, জ্বরে মানুষ আক্রান্ত হতে থাকে। প্রাথমিকভাবে নিউমোনিয়ার প্রকোপ মনে করা হলেও শেষ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয় এটি নভেল করোনাভাইরাস। ২০২০সালের ১১ জানুয়ারি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রথম মৃত্যুর খবর আছে। আস্তে আস্তে এই ভাইরাসটির বিস্তার পৃথিবীর ২০০ অধিত  দেশে পৌঁছে গেছে। করোনাভাইরাসের ভয়াবহ প্রকোপ থেকে বাংলাদেশও রক্ষা পায়নি।

২০২০ সালের ৭ মার্চ ইতালি ফেরত তিন যুবকের শরীরে পরীক্ষা করে করোনাভাইরাস এর অস্তিত্ব বাংলাদেশের প্রথম পাওয়া যায়। এই রোগে আক্রান্ত হয়ে আমাদের দেশে প্রথম ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করেন ১৮ মার্চ ।সংগত কারণেই পৃথিবীর অন্যান্য দেশে মত সংক্রমণ বৃদ্ধি রোধ করার জন্য আমাদের দেশেও ২২ শে মার্চ থেকে লকডাউন ঘোষণা করা হয়। স্কুল কলেজ সহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত,  ব্যাংক বীমা, ঔষধ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দোকান ব্যতীত অন্যান্য সকল দোকানপাট, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য পরিবহন ব্যতীত অন্যান্য পরিবহন, ও জরুরী সেবা ছাড়া সকল কিছু বন্ধ ঘোষণা করা হয়। মানুষ হয়ে পড়ে ঘরবন্দি। বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুসারে স্বাস্থ্যবিধির বিভিন্ন বিষয় জনসাধারণের মধ্যে প্রচার করে। টেলিভিশন ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম  কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে।।করোনাভাইরাস সংক্রান্ত তথ্য জানার আগ্রহ সবার মত আমিও উৎসুক হয়ে থেকেছি। সারাদিন ঘরে থেকে একদিকে যেমন উৎকণ্ঠা তেমনি শুরুতে আনন্দবোধ করেছিলাম  কারণ হঠাৎ করে কলেজ ছুটি হওয়া  ছাত্রজীবনের জন্য বেশ মজার।

 আমরা সবাই সরকার নির্দেশিত বিভিন্ন স্বাস্থ্যবিধি শুরু থেকেই মেনে চলার চেষ্টা করেছি। বাজারে হ্যান্ড ওয়াশ,  মাস্ক, স্যাভলন, ডেটল, লিকুইড সাবান  এর দুষ্প্রাপ্যতা দেখা দেয়। আমরা সবাই হাত পরিষ্কার রাখার জন্য লাইফবয় সাবানের ওপর ভরসা রেখেছিলাম। অসাধু ব্যবসায়ীরা মানুষের অসময়ের সুযোগ নিয়ে অসৎ মুনাফা লাভের উদ্দেশ্যে স্বাস্থ্যসুরক্ষা সামগ্রী অধিক দামে বিক্রি করেছে যা আমাকে ব্যথিত করেছে। একে অন্যের মাধ্যমে যেহেতু এ রোগ ছড়ায় তাই লকডাউন এর শুরুতে মানুষ একে অন্যের বাড়িতে না যাওয়া এমনকি আমাদের এলাকার প্রবেশ পথে বাঁশ দিয়ে আটকে দেওয়া হয়েছিল যাতে করে অন্য এলাকার মানুষ  সহজে প্রবেশ করতে না পারে। লকডাউনে শুরুর দিনগুলোতে ক্লাসের বাইরের বই পড়ার  বিশেষ মনোযোগ দিয়েছিলাম।  সকালের দিকে একটু দেরি করে ঘুম থেকে উঠেছি। শুধু আমি না আমার পরিবারের প্রায় সবাই দেরি করে ঘুম থেকে উঠেছে। কারো কোনো  বাইরে যাবার তাড়া নেই, নেই কোনো বিশেষ ব্যস্ততা। কিছুদিন পরেই যখন ঘরের বাজার ফুরিয়ে যেতে শুরু করল তখন মানুষের মধ্যে বাইরে যাবার প্রবণতা বাড়তে লাগলো। এই সময়ে আমাদের এলাকার জনপ্রতিনিধিরা স্বেচ্ছাসেবকের মাধ্যমে মানুষের কাছে সেবা পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করে। আমিও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের একজন সদস্য হয়ে যায়।  শুরুর দিকে এই কাজে মনে মনে একটু ভয় লাগতো তবে মানুষের  উপকারের কথা মাথায় রেখে সুরক্ষা সামগ্রী পরিধান করে, যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করেছি। জরুরী ঔষধ, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আমরা ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছি। স্বেচ্ছাসেবক টিমের ফোন নম্বর  লেখা কাগজ প্রথমে বাড়িতে বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হতো ,এরপর মানুষ তার প্রয়োজনের কথা জানালে আমরা সে প্রয়োজন মেটানোর চেষ্টা করেছি।

 সরকারের বিভিন্ন সাহায্য সেবার  পাশাপাশি পাড়া-মহল্লার বিত্তবান মানুষেরা সরকারের আহবানে সাড়া দিয়ে দরিদ্র মানুষের ঘরে খাবার পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করে। একটি ব্যাগে নির্দিষ্ট পরিমাণ চাল, ডাল, তেল, লবণ, আলু সহকারে কর্মহীন অসহায় মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছি।আমাদের পরিবারও নিকটবর্তী  দরিদ্র প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনের  পাশে দাঁড়ানোর সামান্য চেষ্টা করেছে। সময় যত অতিক্রম করেছে ততই মানুষের দুর্বিষহ জীবন বৃদ্ধি পেয়েছে। ছোট ছোট ব্যবসায়ী পুঁজি হারিয়ে দিশেহারা হয়েছে। মধ্যবিত্তের জন্য লকডাইনের সময় সবচেয়ে বিব্রতকর অবস্থা ছিল ,কারণ তারা না পারছে সরকারি সহায়তা সরাসরি নিতে আবার  না  পারছে কাউকে কিছু বলতে। ক্ষুদ্র কুটির শিল্প, ছোট ছোট উদ্যোক্তা তাদের  ব্যবসা রক্ষা করতে না পেরে কর্মী ছাঁটাই করে দিয়েছে। আমাদের মহল্লায়  তিনটি বড় মুরগির খাবার ছিল লকডাউনের মধ্যে তার সবকটি বন্ধ হয়ে গেছে।বড় বড় কল কারখানার শ্রমজীবী মানুষ  হারিয়েছে কাজ।  

লকডাউনের প্রথমে দিনগুলো  একটু আনন্দের সঙ্গে কাটলেও আস্তে আস্তে একঘেয়েমি জীবন আমাকে বিপর্যস্ত করতে শুরু করে।  স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে বাইরে যতটুকু কাজ করেছি ততটুকুই আনন্দ পেয়েছি কিন্তু ঘরে আসলেই সেই একই রুটিন। পড়াশোনার চাপ নেই, বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ নেই, আড্ডা তো দেওয়া যাবে না ফলে জীবন কেমন যেন বিমর্ষ হতে লাগলো।একদিকে  করোনাভাইরাসের প্রকোপ যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে তেমনি ভাবেবৃদ্ধি পাচ্ছে অনিশ্চয়তা । কবে পরিস্থিতি ভালো হবে, কবে আমরা আবার সবাই প্রাণখুলে একসঙ্গে আড্ডা ,একসঙ্গে পাড়া-মহল্লায় ঘোরাঘুরি, খেলার মাঠের  হইচই করবো – এসব কিছু আমাকে ভাবিত করে তুলেছিল। প্রতিদিন দুপুর হলেই টেলিভিশনের সামনে বসে দেশের নতুন রোগীর সংখ্যা, মৃত্যুর সংখ্যা,সুস্থতার হার কত তা জানার খুব আগ্রহ  ছিল,  তাও আস্তে আস্তে কমতে শুরু করেছে।  টেলিভিশন দেখতেও খুব একটা আগ্রহ সৃষ্টি হয় না। কখনো বই পড়েছি,, কখনো শুনেছি গান, কখনো আবার আকাশে ঘুড়ি উড়িয়ে আনন্দ পেয়েছি। বাড়িতে বাবা, মা, ভাই, বোন সবাই থাকলেও আস্তে আস্তে মানসিক অবসাদ প্রায় সবাইকে একটু করে আচ্ছন্ন করতে শুরু করেছিল।এর মধ্যেও আমরা পরিবারের সবাই শারীরিক ব্যায়াম করার চেষ্টা করেছি যাতে কিছুটা হলেও সুস্থ থাকা যায়। ভিটামিন জাতীয় খাবার বিশেষত সবুজ শাকসবজি, তাজা ফলমূল, ডিম, মাংস, দুধ খেয়েছি। পরিমাণমতো আয়োডিনযুক্ত লবণ যেমন খেয়েছি তেমনি চিনি জাতীয় খাবার বিশেষত কোমল পানীয় পরিত্যাগ করেছে। প্রতিদিন দুই থেকে তিনবার গরম চা পরিবারের সবাই পান করেছি। ভিটামিন সি জাতীয় খাবার বেশি খেয়েছি। 

 লকডাউন কিছুটা শিথিল হতে থাকলে বাবাকে কাজের প্রয়োজনে বাইরে যেতে শুরু করতে হলো।  বাবা বাইরে থেকে ঘরে ফিরে সরাসরি বাথরুমে চলে  যেতেন এবং পরিধেয়  পোশাক সাবান পানি দিয়ে ভিজিয়ে রেখে দিতেন পাশাপাশি নিজে গোসল করে ফেলতেন। ২২ জুন,২০২০  সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর  বাবা শরীরে  সামান্য জ্বর অনুভব করেন। সাথে ছিল সর্দি এবং শরীর ব্যথা। আমরা সকলেই খুব আতঙ্কিত এবং উৎকন্ঠিত হয়ে পড়লাম, বাবাও বেশ ভেঙ্গে পড়লেন।  কি করবো এই মুহূর্তে কিছুই ভেবে পাচ্ছিলাম না। শুরুতে প্যারাসিটামল জাতীয় ঔষধ বাবা খেতে লাগলো কিন্তু তারপরও জ্বর খুব একটা কমলো না। প্রতিবেশীরা অনেকেই বলাবলি করতে শুরু করল আমাদের বাড়িতে করোনা রোগী আছে।  ২৭ জুন রাতের দিকে বাবার জ্বর  বেশ খানিকটা বেড়ে যায়। আমরা অপেক্ষা করছিলাম কখন সকাল হবে, সকালে আমরা নিকটস্থ স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রে গিয়ে ডাক্তারের পরামর্শ ক্রমে করোনাভাইরাস এর পরীক্ষার জন্য নমুনা দিয়ে আসি।  ডাক্তারের পরামর্শ অনুসারে বাবার ঔষধ এবং খাওয়া-দাওয়া  চলতে থাকে। আমরা সবাই খুব আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। মা এবং বোন বাবার অগোচরে অশ্রুপাত করে। ৩০  জুন বাবার রিপোর্ট হাতে পায়।  রিপোর্ট দেখে আমি আনন্দে কান্না করি, বাবা  করোনা নেগেটিভ। আমাদের পরিবারের জন্য সেদিনটা যে কি আনন্দের তা বোঝানো যাবেনা।  পর দিন  থেকেই বাবা আস্তে আস্তে সুস্থ হতে শুরু করলেন। ডাক্তারের পরামর্শ ক্রমে আমরা ঔষধ এবং অন্যান্য পথ্য চালিয়ে  যাই। আমরা অনুভব করতে পেরেছিলাম একটি পরিবারে  কোন সদস্য  করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে ওই পরিবারের মানসিক অবস্থা কোন পর্যায়ে পৌঁছে যায়। বিশেষ করে রোগীর শারীরিক দুর্বলতা থেকে মানসিক দুর্বলতায় বেশি ভোগে। বাবার  জ্বর থাকা অবস্থায় প্রতিবেশী, আত্মীয় স্বজন আমাদের মানসিক  সান্ত্বনা দিয়েছে, আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে  আবার অনেকে একটু ঘৃণার চোখেও দেখেছে। আমার অভিজ্ঞতা হয়েছে করোনাকালীন সময়ে মানুষ কতটা অসহায় হতে পারে।

 আস্তে আস্তে লকডাউন শিথিল হতে শুরু করেছে, ঘুরতে শুরু করেছে অর্থনীতির চাকা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্যতীত অন্যান্য সকল প্রতিষ্ঠানে চলতে শুরু করেছে। সংক্রমনের হার যে খুব একটা কমেছে এমনটা বলা যাবে না। তবুও মানুষের মধ্যে অনেক ক্ষেত্রেই অসচেতনতা দেখেছি। স্বাস্থ্য বিধি না মেনে শুধু সৃষ্টিকর্তার উপর দায় চাপানোর একপ্রকার চেষ্টাও রয়েছে আমাদের মধ্যে। করোনাভাইরাস চলাকালীন সব থেকে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে নিম্ন আয়ের মানুষ। একদিকে  কাজের অভাব অন্যদিকে বাজারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি। সার্বিক ভাবে বলতে গেলে প্রায় সব স্তরের মানুষকে করোনাভাইরাস এর তিক্ত অভিজ্ঞতা কোন না কোন ভাবে পেতে হয়েছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top