ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীতে বাংলার অবস্থান নির্ণয় কর

Spread the love

 ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীতে  বাংলার অবস্থান নির্ণয় কর

পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার ইতিহাস আলােচনা করে পণ্ডিতেরা ভাষাকে কয়েকটি গােষ্ঠীতে ভাগ করেছেন। বিভিন্ন ভাষার ক্রমপরিণতির বিভিন্ন স্তরের মধ্যে শব্দ ও ব্যাকরণে মিল থাকলে অথবা দুটি ভাষার আদি রূপের মিল পাওয়া গেলে তাদের এক ভাষাগােষ্ঠীর অন্তর্গত বলে মনে করা হয়। ইন্দো-ইউরােপীয় মূল ভাষাগােষ্ঠী এমনি একটি ভাষাগােষ্ঠী হিসেবে বিবেচিত। 

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বলেছেন, আজ থেকে ন্যূনাধিক ৫০০০ হাজার বছর পূর্বে এক জাতি ইউরােপের মধ্য ভাগ থেকে দক্ষিণ-পূর্বাংশ ভূ-ভাগে বাস করত এবং তারা মােটামুটি একই ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করত। এ ভাষাকে ইন্দো- ইউরােপীয় মূল ভাষা বলা যায়।

ইন্দো-ইউরােপীয় মূল ভাষার অবস্থান সম্পর্কে ড. রফিকুল ইসলাম মন্তব্য করেছেন, বিভিন্ন ভাষার আদি জননী ইন্দো-ইউরােপীয় ভাষা পৃথিবীর কোন অঞ্চল থেকে উদ্ভূত তা নিয়ে মতভেদ আছে। একটি মত হল এই যে, ইন্দো-ইউরােপীয় ভাষার আদি পীঠস্থান মধ্য এশিয়ার কিরগিজ তৃণভূমি, কাস্পিয়ান সাগরের উত্তর ও আরব সাগরের মধ্যবর্তী ভূখণ্ড বা কৃষ্ণসাগর অথবা কাস্পিয়ান সাগরের মধ্যবর্তী অঞ্চল। আর একটি মত হল এই যে, ইন্দো-ইউরােপীয় ভাষার প্রাচীন বাসস্থান হল স্কেন্ডিনেভিয়া এবং উত্তর জার্মানি সংলগ্ন অঞ্চল অথবা দানিয়ুব উপত্যকা বিশেষত হাঙ্গেরির সমতলভূমি। প্রথমােক্ত অঞ্চল অর্থাৎ দক্ষিণ-পূর্ব রাশিয়া বা কিরগিজস্তানের ঊষর অঞ্চলই যে আদি ইন্দো-ইউরােপীয় বাসভূমি এ মতামতই অধিকতর সমর্থিত। মূল ইন্দো-ইউরােপীয় ভাষার কোন নিদর্শন পাওয়া যায়নি, সংস্কৃত, গ্রীক ও লাতিনের তুলনামূলক পর্যালােচনার মধ্য দিয়ে মূল ইন্দো-ইউরােপীয় ভাষার আনুমানিক রূপ পুনর্গঠন করা হয়েছে।

ইন্দো-ইউরােপীয় ভাষাগােষ্ঠীর মধ্যে আছে এশিয়া ও ইউরােপের অধিকাংশ প্রাচীন ভাষা ও তাদের আধুনিক শাখাগুলাে। বৈদিক, প্রাচীন পারসিক, প্রাচীন গ্রিক, ল্যাটিন, প্রাচীন জার্মান, আর্মেনিয়ান, আবেস্তীয়, প্রাচীন কেলটিক, প্রাচীন ইটালীয় সবই এসেছে ইন্দো-ইউরােপীয় ভাষাগােষ্ঠী থেকে। এদের ক্রমপরিবর্তিত আধুনিক রূপ ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান, গ্রিক, ইটালিয়ান, নরওয়েজিয়ান, ওলন্দাজ, রুশ, সুইডিশ ইত্যাদি ইউরােপীয় আধুনিক ভাষাগুলাে। হিন্দি, বাংলা, গুজরাটি, অসমীয়া, ওড়িয়া, রাজস্থানি, সিন্ধি ইত্যাদি আধুনিক ভাষা গুলো এসেছে ইন্দো-ইউরােপীয় মূল ভাষা থেকে। নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এরা আজকের রূপ পেয়েছে। ইন্দো-ইউরােপীয় ভাষাগােষ্ঠীর প্রাচীন শাখা নয়টি। কেলটিক, ইটালিক, জার্মানিক, আলবেনিয়ান, আর্মেনিয়ান, তুখারিয়ান, বাল্টোস্লাভিক, গ্রিক ও ইন্দা-ইরানীয়। ভারতীয় প্রধান প্রধান ভাষা এসেছে এই ইন্দো-ইরানীয় শাখা থেকে।

‘ইন্দো-ইউরােপীয় নামটি ফরাসিদের দেওয়া। এই ভাষায় যারা কথা বলত তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাস করত ইউরােপে ও এশিয়ায় এবং তার দক্ষিণতম সীমা ভারত পর্যন্ত বিস্তৃত বলে মনে করা হয়। শত শত বছর ধরে মূল ভাষায় যারা কথা বলত তারা যাযাবরের মত ছড়িয়ে যায় পৃথিবীর নানান অঞ্চলে। ক্রমে তাদের ভাষায়ও আসে নানান পরিবর্তন। পণ্ডিতেরা মূল ইন্দো-ইউরােপীয় ভাষার কোন নমুনা হাজির করতে পারেন নি। সেই ভাষার কোনও আদর্শই আমাদের জানা নেই। তবে ঐ ভাষা থেকে উদ্ভূত অন্য ভাষাগুলাের বৈশিষ্ট্য থেকে মূল ভাষার অস্তিত্ব অনুমান করা গেছে।

ইন্দো-ইউরােপীয় মূল ভাষা দুটি শাখায় বিভক্ত হয়। একটি কেন্তুম শাখা এবং অপরটির নাম শতম শাখা। মূল ভাষার তালব্য ‘ক’ ধ্বনির উচ্চারণ পার্থক্য থেকেই এই বিভাগের সৃষ্টি। যেসব ভাষায় মূল ভাষার ‘ক’ ধ্বনি রক্ষিত সেসব ভাষাকে কেন্তুম আর যেসব ভাষায় তা ‘স’ ধ্বনিতে পরিবর্তিত সেগুলােকে ‘শতম’ বলা হয়। কেন্তুম বিভাগের সঙ্গে বাংলা ভাষায় কোন সাক্ষাৎ সম্পর্ক নেই তবে শতম বিভাগ থেকে যে আর্য শাখা উদ্ভূত হয় তার সঙ্গেই বাংলা ভাষার সাক্ষাৎ সম্পর্ক রয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশের ইন্দো-ইউরোপীয় আর্য ভাষাগুলাে শতম শাখার অন্তর্ভুক্ত। শতম শাখার কাল ৩৫০০ খ্রিঃ পূঃ বলে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ মনে করেছেন।

কেন্তুম শাখা থেকে সৃষ্ট ভাষাগুলাে হল- গ্রিক, ইতালাে-কেলটিক, টিউটোনিক, হিত্তি ও তুখারি। ইতালাে-কেলটিক পরে ইতালিক ও কেলটিক দুই ভাষায় পরিণত হয়। ইতালিক থেকে লাতিন প্রভৃতি এবং কথ্য লাতিন থেকে বর্তমান ফরাসি, ইতালিয়ান, পর্তুগিজ, স্পেনিশ, রুমানিয়ান প্রভৃতি ভাষা উৎপন্ন হয়েছে। 

ইন্দো-ইউরোপীয় মূল ভাষা থেকে নানা ভাষাস্তরের বিবর্তনের মধ্য দিয়েই বাংলার উদ্ভব ঘটেছে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর অভিমত নিম্নে আলোচনা হল:

১। আদিম স্তর: প্রাচীন ভারতীয় আর্য (Old Indo-Aryan) এবং আদিম প্রাকৃত (১২০০- ৫০০ খ্রি.)।
২। মধ্যস্তর : মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষা (Middle Indo-Aryan) এর তিনটি উপস্তর আছে।

(ক) প্রথম উপস্তর : অশোকের অনুশাসন লিপি, সাঁচি ও বাহৃর্তের প্রস্তর লিপি, খারবেল লিপি প্রভৃতি প্রথম স্তরের ভাষা। পালি এর একটি সাহিত্যিক রূপ। সংস্কৃত এ যুগের ব্রাহ্মণ্য সমাজের সাহিত্যিক ভাষা ছিল। এটি আদিম ও মধ্যস্তরের অর্ন্তবর্তী ৫০০ খ্রি.. পূর্ব হতে ১০০ খ্রি. পর্যন্ত এই উপস্তর। একে প্রাচীন প্রাকৃত বলা যায়।

(খ) দ্বিতীয় উপস্তর : ২০০ খ্রি. থেকে ৪৫০ খ্রি. পর্যন্ত ভাষাকে প্রাকৃত ভাষা বলা যায়। পরবর্তীতে এ ভাষা সংস্কৃত নাটকে ও জৈন সাহিত্যে ব্যবহৃত হয়েছে ।

(গ) তৃতীয় উপস্তর : অপভ্রংশ স্তর ৪৫০ খ্রি. থেকে ৬৫০ খ্রি. পর্যন্ত । সমকালীন ভাষারীতিকে অবলম্বন করে প্রাকৃত অপভ্রংশের অস্তিত্ব। কিন্তু প্রথম পর্যায়ে এ ভাষা বৌদ্ধ বা জৈন সমাজে ব্যবহৃত হত। পরবর্তিতে ব্রাহ্মণ্য সমাজেও অপভ্রংশ ব্যবহৃত হতে থাকে।

৩। আধুনিক স্তর : নব্য ভারতীয় আর্যভাষার প্রাচীনতম রূপ ৬৫০ খ্রি. থেকেই বাংলা ভাষায় ফুটে ওঠে এবং এ পর্যায়ের বিস্তার আধুনিককাল পর্যন্ত । বাঙ্গালা ভাষা প্রাচীন রূপ পরিবর্তন করে মধ্য বাংলায় পরিণত হয়। এই মধ্য বাংলা থেকেই আধুনিক বাংলা ভাষার উৎপত্তি।

প্রাচীন বাংলা– ৬৫০ খ্রি. থেকে ১২০০ খ্রি.।
সন্ধিযুগ– ১২০১ খ্রি. থেকে ১৩৫০ খ্রি.।
মধ্যযুগ– ১৩৫১ খ্রি. থেকে ১৮০০ খ্রি.।
আধুনিকযুগ– ১৮০১ খ্রি. থেকে বর্তমান পর্যন্ত।

নিম্নে ছক আকারে ইন্দো ইউরোপীয় ভাষা স্তর থেকে বাংলা ভাষা পর্যন্ত ক্রম বিবর্তনের চিত্র তুলে ধরা হল-

বাঙলা-ভাষার-বিবর্তনের-রূপরেখা

1 thought on “ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীতে বাংলার অবস্থান নির্ণয় কর”

  1. Pingback: বাংলা ভাষার ইতিহাস ও ব্যবহারিক বাংলা সাজেসন্স | Cholo Shekhe

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top