Spread the love

করোনাভাইরাস প্রবন্ধ বা,  নভেল করোনাভাইরাস – বৈশ্বিক ও বাংলাদেশ পরিস্থিতি প্রবন্ধ বা , কোভিড – ১৯ প্রবন্ধ

চীনের হুবেই প্রদেশের  উহান শহরে ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর করোনাভাইরাস এর প্রথম প্রাদুর্ভাব ঘাটে  এবং পরবর্তী বছর অর্থাৎ ২০২০ সালের ১১ জানুয়ারি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রথম মৃত্যু ঘটে ঐ উহান শহরে।সারা পৃথিবী করোনাভাইরাস শব্দটির সঙ্গে পর্যায়ক্রমে পরিচিত হতে থাকে। গবেষণা হতে থাকে কিভাবে এই ভাইরাসটি প্রথম ছড়িয়েছে।

সূচনা:   নীল আকাশের বুক চিরে রাতের আঁধার নিশ্চিহ্ন করে জেগে ওঠে সকালের সূর্য যার পূর্বাভাস পায় পাখির কলকাকলির মধ্য দিয়ে। দিন বাড়তেই কর্মমুখর মানুষ ব্যস্ত হয়ে পড়ে তার কর্মময় জীবনের উদ্দেশ্যে যাত্রার জন্য কিন্তু এই চিরচেনা  আধুনিক মানব সভ্যতা আজ স্তব্ধ। কারণ আজকের পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে ভয়ঙ্কর নভেল করোনাভাইরাস যা কোভিড ১৯ নামের ভাইরাস। করোনাভাইরাস নামের অদৃশ্য শত্রু’ কারণে মানুষ হয়ে পড়েছে গৃহবন্দী। ভয়, আতঙ্ক আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাবার প্রত্যাশায় দিন গুনছে  সারা পৃথিবী। ২০২০ সালের ১১ মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বৈশ্বিক মহামারীর বিপদ সংকেত জানানোর ফলে সারা পৃথিবীর মানুষের স্বাভাবিক জীবনের ছন্দপতন ঘটে, সমস্ত বিশ্বে হয়ে পড়ে হতবাক। আজকের আধুনিক জ্ঞান সম্পন্ন পৃথিবীর মানুষ ভয়াবহ কভিড ১৯ বা  করোনাভাইরাস  শব্দটির সঙ্গে  পরিচিত হতে শুরু করে। এর  প্রভাবে বড় বড় অর্থনৈতিক পরাশক্তি দেশ ভয়াবহ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্যে পতিত হচ্ছে। বিশেষত উন্নয়নশীল ও অনুন্নত  বিশ্বকে আরো পেছনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে এই ভাইরাস । বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী সারা পৃথিবীর  মানুষকে সতর্কতার সঙ্গে  থাকতে হবে এবং প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। করোনার প্রাদুর্ভাব রোধে জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত বিশ্ব প্রতিষেধক আবিষ্কারে প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যাচ্ছে। 

আমাদের প্রত্যাশা- ‘এই আঁধার কেটে যাবে, পৃথিবী  আবার ফিরে পাবে তার আপন মহিমা’।

মহামারীর  সংজ্ঞা : কোন একটি রোগ যদি বিস্তৃত অঞ্চল বিশেষত কয়েকটি দেশ বা মহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং সেসব অঞ্চলের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ওই রোগে আক্রান্ত হয় বা আক্রান্ত হওয়ার ঝুকি থাকে তাহলে তাকে মহামারী আখ্যা দেওয়া  হয়। আরও সহজভাবে বলতে গেলে রোগটি প্রায় সারা পৃথিবীর মানুষকে প্রভাবিত করবে। মহামারীর আরো একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো এটি সংক্রামক রোগ হবে অর্থাৎ একজনের  সংস্পর্শে আর একজন আক্রান্ত হবার  ঝুঁকি থাকবে।

করোনাভাইরাসের প্রথম প্রাদুর্ভাব : চীনের হুবেই প্রদেশের  উহান শহরে ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর করোনাভাইরাস এর প্রথম প্রাদুর্ভাব ঘাটে  এবং পরবর্তী বছর অর্থাৎ ২০২০ সালের ১১ জানুয়ারি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রথম মৃত্যু ঘটে ঐ উহান শহরে।সারা পৃথিবী করোনাভাইরাস শব্দটির সঙ্গে পর্যায়ক্রমে পরিচিত হতে থাকে। গবেষণা হতে থাকে কিভাবে এই ভাইরাসটি প্রথম ছড়িয়েছে। ধারণা করা হয় প্রাণীদেহে বিশেষ করে বাদুড় বা বন্যপ্রাণী থেকে  এই ভাইরাস  মানবদেহে প্রবেশ করেছে। পরবর্তী সময়ে কোন ঐ ব্যক্তির মধ্য দিয়ে অন্য ব্যক্তি আক্রান্ত হয়েছে এভাবেই এই রোগের  সূচনা  ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে এই ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত বলে মনে করেছিল কারণ রোগীর শরীরে জ্বর ছিল  কিন্তু পরবর্তী সময়ে রোগের জিনগত বৈশিষ্ট্য বিবেচনা করে বিজ্ঞানীরা এটিকে একটি নতুন করোনাভাইরাস  হিসেবে চিহ্নিত করেন। 

করোনাভাইরাস কী : করোনাভাইরাস এর অপর নাম covid-19। যার co অর্থ হলো করোনা, vi  ভাইরাস, D হলো ডিজিজ , ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ার সময় ২০১৯ সাল তাই এর নাম হয়েছে covid-19। করোনাভাইরাস এর একাধিক শ্রেণী বিভাগ রয়েছে কিন্তু তার ভেতর অল্পসংখ্যক মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়ে থাকে। করোনাভাইরাস করোনাভিডি ধারার ভাইরাস। covid-19 বা করোনাভাইরাস  প্রাণীদেহে সংক্রমিত হয়ে থাকে। করোনাভাইরাস শব্দটি ল্যাটিন শব্দ থেকে বাংলায় এসেছে যার অর্থ মালা বা মুকুট । বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে দৃশ্যমান এই ভাইরাসটির আকৃতি গোলাকার এবং বেশির ভাগ অংশই মুকুট এর মত দেখতে ।এটি মূলত একটি আর এন এ গোত্রের ভাইরাস ।অন্যান্য ভাইরাসের থেকে এই ভাইরাসটি মানুষকে বেশি চিন্তায় ফেলেছে কারণ এর প্রতিষেধক নেই একই সঙ্গে ভাইরাসটির জিনগত গঠন অত্যন্ত জটিল ।একই সাথে এটি দ্রুত রূপ পরিবর্তন করে ফেলতে পারে। ভাইরাসটির জীনতত্ত্ব আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে কার্যকর টিকা পাওয়ার জন্য বিস্তর গবেষণা চলছে। উচ্চতর গবেষণার মধ্য দিয়ে  করোনাভাইরাস কে প্রতিহত করতে সক্ষম  প্রতিষেধক পাওয়াই বর্তমান বিশ্বের একমাত্র আকাঙ্ক্ষা।

করোনাভাইরাস  সংক্রমণের মাধ্যম : করোনাভাইরাস সর্দি বা ফ্লু এর মাধ্যমে সংক্রমিত হয়ে থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনাভাইরাস সংক্রমনের মাধ্যম হিসেবে বেশ কিছু নির্দেশনা প্রকাশ করেছে। আক্রান্ত ব্যক্তির বিশেষত হাঁচি-কাশির মাধ্যমে এ ভাইরাস ছড়ায়ে। আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশির ক্ষুদ্রতম কণা বাতাসে ভেসে থাকা অবস্থায় সুস্থ মানুষের দেহে শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে প্রবেশ করলে ভাইরাসটি সংক্রমিত হয়। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কোন ব্যক্তির মুখের ড্রপলেট বা অতিক্ষুদ্র হাঁচি-কাশির কণা  অপর কোন ব্যক্তির হাত দ্বারা চোখ, নাক, মুখ এর মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করতে পারে ।মসৃণ কোন স্থানে বিশেষত জামাকাপড় বা শরীরের অন্য কোন অংশে লেগে থাকা ভাইরাসটির অতি ক্ষুদ্র কণা যে কোন মাধ্যমে আমাদের শরীরে প্রবেশ করলে ভাইরাসটি  দ্বারা সংক্রমিত  হতে হবে। বিশেষভাবে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিক,  ফুসফুস জনিত রোগ এবং,এ্যাজমা রোগীর  জন্য এই ভাইরাসটি অত্যন্ত ভয়ঙ্কর।যারা অধিক পরিমাণে ধূমপান করে তারা তামাক জাতীয় দ্রব্য গ্রহণের সময় করনা ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে ।পানির মাধ্যমে করোনা ভাইরাস ছড়ায় এমন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বিশেষত ভূগর্ভস্থ পানি যথেষ্ট নিরাপদ। এমনকি বাজারের কাঁচা শাকসবজি বা ফলমূলের মাধ্যমে করোনা ভাইরাস ছড়ায় না। করোনাভাইরাস অনেকটা আবৃত ভাইরাস ফলে এটি মানুষের নাক মুখ চোখ এর মাধ্যমে শ্বাসতন্ত্রের প্রবেশ করার পর বা তার দেহ  অভ্যন্তরে প্রবেশ করার পর ভাইরাস এর কার্যকারিতা শুরু করতে পারে। 

 করোভাইরাসের আক্রান্তের লক্ষণ :  করোনাভাইরাস মানবদেহে প্রবেশ করার সাsymptomsথে সাথেই এর লক্ষণ প্রকাশ পায় না। শারীরিক সক্ষমতার উপর ভিত্তি করে সর্বোচ্চ ১৪ দিন বা  কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরও একটু বেশী সময়ের মধ্যে এ রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। ফ্লু জাতীয় ভাইরাস হাওয়াতে শুধু সর্দি বা জ্বর হলেই তাকে করোনা রোগী বিবেচনা করা যাবে না।আবার অনেক সময় শুধু মাথা ব্যাথা থাকলেই অনেকে মনে করেন তার করনা হয়েছে কিনা। তবে শুধু জ্বর বা মাথাব্যথা থাকলেই তাকে করনা রোগী হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না, এর আরো কিছু লক্ষণ প্রকাশ পাবে যেমন- 

  • শরীরের জ্বর থাকবে।
  • হাঁচি কাশি
  • বমি হতে পারে।
  • মুখের স্বাদ ,গন্ধ থাকবে না।
  • শরীর ব্যাথা হবে।
  • শরীর ক্লান্ত বা অবসাদগ্রস্থ মনে হবে।
  • ফুসফুস আক্রান্ত হয়ে নিউমোনিয়া হতে পারে।
  • শরীরে অন্য কোনো জটিল রোগ থাকলে সেটিও আরো জটিল  রূপ  ধারণ করতে পারে।

করোনায় আক্রান্ত রোগীর ঝুঁকি:  এক কথায় বলতে গেলে সারা পৃথিবীর মানুষ আজ করোনাভাইরাসের ঝুঁকিতে রয়েছে।বিশেষত প্রতিষেধক আবিষ্কৃত না হওয়ায় এর প্রকোপ মানুষকে ভাবিত করে চলেছে। এই ভাইরাস বিস্তার লাভ করার শুরুতে ভাবা হয়েছিল গরম আবহাওয়াতে এটি খুব সক্রিয় থাকবে না কিন্তু আফ্রিকা মহাদেশ, এশিয়ার মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বিশেষত ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, বাংলাদেশসহ অন্যান্য গরম আবহাওয়ায় দেশে করোনাভাইরাস জিনগত পরিবর্তনের মাধ্যমে ভয়াবহভাবে তার বিস্তার ঘটিয়ে চলেছে। আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার উপর এই ভাইরাসের প্রভাব বিস্তারের বিষয় কিছুটা নির্ভর করলেও  গড়ে সব বয়সের মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। বিশেষত বয়স্ক এবং শিশুদের শরীরে স্বাভাবিকভাবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকায় তারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। অধিক ধূমপায়ী  ব্যক্তি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকবে। যারা অধিক পরিমাণে অ্যালকোহল জাতীয় পদার্থ গ্রহণ করেন তাদেরও করোনায় আক্রান্ত সম্ভাবনা রয়েছে। 

করোনাভাইরাস এর চিকিৎসা:  বাস্তবতাকে স্বীকার করে নিয়ে গবেষণা চলছে করোনা ভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কার এর জন্য কিন্তু এখনো পর্যন্ত শতভাগ কার্যকরী কোন চিকিৎসা পদ্ধতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদন দেয়নি। সুখের বিষয় এই যে প্রায় ৮০ শতাংশ রোগী বাড়িতে থেকে চিকিৎসা গ্রহণের সুস্থতা লাভ করতে পারে।প্রাথমিকভাবে সেবনের জন্য প্যারাসিটামল ঔষধ দেয়া হয়ে থাকে।তবে  যদি কোন কারণে আক্রান্ত রোগীর বিন্দুমাত্র শ্বাসকষ্ট দেখা দেয় তাহলে দেরি না করে তাকে অবশ্যই হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। প্রথম দিকে প্রতিশেষধ হিসেবে গুরুতর ভাবে আক্রান্ত রোগীর শরীরে রেমেডিফিভর  নামের একটি  ঔষধ ব্যবহারে হচ্ছে। পাশাপাশি প্লাজমা থেরাপি অর্থাৎ  করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তি সুস্থ হবার পর তার রক্তে স্বয়ংক্রিয়ভাবে এক ধরনের এন্টিবডি তৈরি হয় পরবর্তী সময়ে তার শরীর থেকে  রক্ত সংগ্রহ করে বিশেষ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নতুন আক্রান্ত রোগীর শরীরে প্রবেশ করালে কিছু সুফল  পাওয়া যাচ্ছে তবে তা একেবারেই সামান্য। অক্সিজেন এবং ভেন্টিলেশন এর মাধ্যমে শ্বাসকষ্ট সৃষ্টি হওয়া রোগীদের চিকিৎসা সহায়তা  দেওয়া হচ্ছে। সমগ্র পৃথিবীর কভিড ১৯  পরীক্ষা, চিকিৎসা, বৈশ্বিক সহযোগিতা এবং ভ্যাকসিন আবিষ্কারে সহযোগিতা করছে  COVAX সুবিধা। ভ্যাকসিন আবিষ্কার এর জন্য সারা পৃথিবীতে ২৭২ টি করোনাভাইরাসের টিকা উদ্ভাবনের উদ্যোগ বিশ্বজুড়ে, এর মধ্যে ১৮৬ টি উদ্ভাবন পর্য ায়ে বয়েছে, ৮৬ টি মানব দেহে পরীক্ষার বিভিন্ন ধাপে রয়েছে। ইতোমধ্যে কার্যকরী সাতটি টিকা যা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রয়োগ শুরু হয়েছে। চীনের সিনোফামের্র টিকা ৮৬% কার্যকর, চীনের সিনোভ্যাক ৭৯% কার্যকর, রাশিয়ার তৈরি স্পুতনিক -ভি ৯১.৬% কার্যকর, ফাইজার-বায়োএনটেক এর টিকা ৯১.৩% কার্যকর, জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকা ৬৬.৯% কার্যকর,অ্যাস্টেজেনেকার টিকা ৭৬% কার্যকর এবং মর্ডানাার টিকা ৯০% কার্যকর ( তথ্য সূত্র- বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও নিউইয়র্ক টাইমস)।

করোনাকালীন সময়ের খাবার  ও জীবনাচরণ: করোনাকালীন সময়ে পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ যেমন প্রয়োজন তেমনি কিছু খাবার কে বাদ দেওয়া প্রয়োজন। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে ভিটামিন,  খনিজ ও প্রোটিন জাতীয় খাবার প্রয়োজন এজন্য  তাজা ফলমূল, সবুজ শাকসবজি, চাল ও আটা তৈরি খাদ্য, আমলকি ভিটামিন সি জাতীয় খাবার খুব জরুরী। ১ থেকে ২ বার গরম চা পান করতে হবে।প্রাণীদেহে থেকে প্রাপ্ত মাংস, দুধ, ডিম খেতে হবে।কোনভাবেই অল্প সেদ্ধ মাংস,অল্প সেদ্ধ ডিম খাওয়া যাবেনা। আয়োডিনযুক্ত লবণ গ্রহণ করতে হবে কোনভাবেই অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ করা যাবে না।পাশাপাশি চিনিজাতীয় খাবার পরিহার করতে হবে। অ্যালকোহল ও ধূমপান স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে হবে কারণ এসব  পদার্থ শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস করে। অনেকেই মনে করে থাকেন যে আলকোহল করোনাভাইরাস কে মেরে ফেলতে পারে কিন্তু এটি একেবারেই ভিত্তিহীন চিন্তা। প্রতিদিন ব্যায়াম করতে হবে। যেহেতু আমরা ঘরের বাইরে যেতে পারছিনা  সেহেতু ঘরের মধ্যে,  ছাদে,  নিজ আঙিনায়  প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ মিনিট ব্যায়াম করতে হবে।শারীরিক ব্যায়ামের জন্য সাঁতার খুব কার্যকারী একটি মাধ্যম। সম্ভব হলে প্রতিদিন দশ পনের মিনিট সাঁতার কাটতে হবে। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিত স্বাস্থ্যবিধি : করোনাভাইরাসের  সংক্রমণ রোধের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সকলকে ঘরে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। সংক্রমণ ব্যাধি বৃদ্ধির ফলে প্রতিটি দেশের সরকারকে লকডাউনের পরামর্শ দিয়েছেন। অতি প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘর থেকে বের হতে পারবে না ।সংক্রমণ কমে আসলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে লকডাউন শিথিল করা যাবে তবে সে সময়ে পরিপূর্ণ স্বাস্থ্যবিধি সকলকে মেনে চলতে হবে। ঘরের বাইরে বের হতে চাইলে ব্যক্তিগত  সুরক্ষা সামগ্রী(  পিপিই), হ্যান্ডগ্লাবস,ফেস সিল্ড,মাস্ক, চুল ঢেকে রাখার আবরণ এবং পায়ে জুতা ব্যবহার করতে হবে। বাইরে থেকে এসে পরিধেয় পোশাক বাথরুমে সাবান পানিতে কম পক্ষে ৩০ মিনিট ভিজিয়ে রাখতে হবে। হাত সাবান পানি দিয়ে কম পক্ষে ২০ সেকেন্ড ধুতে হবে এবং গোসল করে ফেলতে হবে। ঘরে অবস্থানরত ব্যক্তিরা ২০ মিনিট পর পর ২০ সেকেন্ড করে হাত পরিষ্কার করবে। হাঁচি-কাশির  সময় টিসু অথবা কাপড় ব্যবহার করতে হবে এবং ব্যবহৃত টিসু বা কাপড় ঢাকনা যুক্ত স্থানে ফেলতে হবে। কাপড় বা টিসু না-থাকে তবে  কনুই ব্যবহার করতে হবে যেনো আপনার মুখের ড্রপলোট বা থুথুর কণা অন্যের শরীরে না লাগে।সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে হবে অর্থাৎ একজনের থেকে অন্যজন কমপক্ষে তিন ফুট দূরে অবস্থান করতে হবে। হ্যান্ডশেক, কোলাকুলি থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকতে হবে। হাত দিয়ে সচরাচর নাক, মুখ, চোখ স্পর্শ করা যাবে না। জনসমাবেশ বাঞ্ছনীয় নয়। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে আতঙ্কিত না হয়ে ডাক্তারের পরামর্শ ক্রমে কমপক্ষে ১৪ দিন আইসোলেশন  বা কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে ।যদি শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায় বা অন্য জটিলতা দেখা দেয় তাহলে অবশ্যই হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। ঘরে স্থায়ী ভাবে থাকা জিনিসপত্র বিশেষত দরজার হাতল, বাসার রেলিং, মোবাইল কি-প্যাড, ল্যাপটপ, কম্পিউটার, ঘরের মেঝে, বিছানার চাদর, সবকিছু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। লিফটের বোতাম, এটিএম বুথের  বোতাম ব্যবহারের ক্ষেত্রে সচেতন থাকতে হবে। 

করোনাভাইরাস বিস্তার রোধে করণীয় : নিজে সুরক্ষিত থাকব এবং অন্যকে সুরক্ষিত রাখব-  এই স্লোগান করোনাভাইরাস বিস্তার রোধে সবচেয়ে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে। w.h.o. নির্দেশনা অনুসারে আমাদের সকলকে চলতে হবে। ব্যক্তিগত  সুরক্ষা সামগ্রী  ব্যবহারের পাশাপাশি সকলকে সচেতন থাকতে হবে। কোনভাবেই  মাস্ক   ব্যতীত ঘরের বাইরে যাওয়া যাবে না। গণপরিবহন এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতে হবে, বাইরে থাকা অবস্থায় বার বার  হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে হবে। নিজেদের আবাসস্থল পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। করোনাকে ভয় নয় সচেতনার মাধ্যমে করব জয় এই বিশ্বাসকে ধারণ করে আমাদেরকে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।

করোনায় বৈশ্বিক পরিস্থিতি: করোনাভাইরাস শুরু হয়েছিল চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহর থেকে। তবে এই ভাইরাসের বিস্তার ঘটেছে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ ও অঞ্চলে, সংখ্যার বিচারে তা প্রায় ২২১ টি। সর্বশেষ তথ্য অনুসারে সবথেকে বেশি আক্রান্ত এবং মৃত্যু হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে । এছাড়া মহামারী ভয়াবহ আকারে দেখা দিয়েছে ভারত, ব্রাজিল, রাশিয়া, আর্জেন্টিনা, কলম্বিয়া, স্পেন, পেরু, মেক্সিকো, যুক্তরাজ্য, চিলি,  বাংলাদেশ, পাকিস্তান, সহ পৃথিবীর অনেক দেশে।মানবিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে সারা পৃথিবী অতিক্রম করছে একটি দুর্বিষহ সময়।করোনাভাইরাসের প্রভাবে স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হয়েছে, মানুষ হয়ে পড়েছে ঘরবন্দি, বন্ধ হয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্য, পুঁজি হারিয়ে অসহায় হয়েছেন অনেক মালিক, কাজ হারিয়ে অনেকেই মানবেতর জীবনযাপন করছে। রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি হওয়াতে হাসপাতালগুলোতে বেড়েছে ভিড় যা ডাক্তারদের ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছে সব সময়। হাসপাতালে তুলনায় রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি হাওয়াতে চিকিৎসা দিতে সকলদেশের ডাক্তারদের হিমশিম খেতে  হচ্ছে। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা উপকরণের সংকট দেখা দিয়েছে। বিশেষত অক্সিজেন ও ভেন্টিলেশন এর অভাব চরমে পৌঁছেছে। উন্নয়নশীল দেশ আবার পরিণত হচ্ছে অনুন্নত দেশে। উন্নত বিশ্বের মেরুদন্ড যে অর্থনৈতিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ছে। কমেছে পৃথিবীর ব্যবসা-বাণিজ্য, জীবন যাত্রার মান যাচ্ছে নিচের দিকে । দেশে দেশে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিতে শুরু করেছে , শেয়ারবাজারের  সূচক প্রতিনিয়ত হচ্ছে নিম্নমুখী। প্রতিষ্ঠিত অনেক কোম্পানি বন্ধ হওয়ার পথে। আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি করোনাভাইরাস সমগ্র পৃথিবীর জন্য চরম সংকট  নিয়ে এসেছে। বিশেষত যেসব দেশ প্রবাসী আয়ের ওপর  অনেকাংশে নির্ভর করে সেসব দেশের অবস্থা খুব বেশি খারাপ। ভারতের পরিজায় শ্রমিকেরা  কাজ হারিয়ে  দিশেহারা। সর্বোপরি সারা পৃথিবীর অর্থনৈতিক লেনদেন হয়েছে নিম্নমুখী। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মতে এই বছর সারা পৃথিবীতে আমদানি রপ্তানি কমেছে প্রায় ৩২ শতাংশ। করোনার ২য় ঢেউ পৃথিবীকে নতুন করে আতঙ্কের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে ভারতে যে সংখ্যা এখন প্রতিদিন ৩ লাখ ৪০ হাজার অধিক। কল্পনাতিত ভাবে প্রতিদিন সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে । অক্সিজেনের অভাবে ভারতে মানুষ মারা যাচ্ছে। হাসপাতালে সিট খালি না থাকার ফলে মন্দির,মসজিদ,গির্জা , গুরুদুয়ারা হয়ে উঠেছে অস্থায়ী হাসপাতাল। দিল্লির শ্মসানগুলো শবদাহ করতে হিমশিম খাচ্ছে তাই অস্থায়ী ভাবে শ্মশান তৈরি করা হয়েছে। রাত দিন শ্মশান,কবর স্থানে শেষ কৃত্য চলছে। অসহায় মানুষগুলো আজ দিশেহারা। বাংলাদেশ,পাকিস্তান,যুক্তরাষ্ট্র,যুক্তরাজ্য,ব্রাজিল,দক্ষিণ আফ্রিকা সহ পৃথিবীর বহুদেশে করোনার প্রাভাব কেনো ভাবেই কমছে না। আক্রান্তে প্রথম পাঁচে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র,ভারত,ব্রাজিল,ফ্রান্স,রাশিয়া। দক্ষিণ এশিয়াতে ভারত,পাকিস্তান,বাংলাদেশে করোনা রোগি বেশি।

করোনাকালে আন্তর্জাতিক সংস্থার ভূমিকা : আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ মানুষের মঙ্গল সাধন এর জন্যই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মানব সভ্যতার এই চরম দুঃসময়ে আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। w.h.o  প্রতিনিয়ত সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে করোনাভাইরাস এর সর্বশেষ পরিস্থিতি এবং করণীয় সম্পর্কে সচেতন করে যাচ্ছে। একেবারে শুরু থেকেই এ ভাইরাসের সংক্রমণ রোধের জন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য বিধি প্রণয়ন করেছে তারা। করোনা ভাইরাস সম্পর্কে বিভিন্ন দেশে তৈরি হওয়া ভিত্তিহীন ধারণাগুলোকে  রোধ করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। একই সঙ্গে সমগ্র পৃথিবীর মানুষকে একত্রিত হয়ে এই ভাইরাস মোকাবেলায় পরামর্শ দিয়েছে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থা করোনায় আক্রান্ত দরিদ্র দেশ সমূহ খাবার সহায়তা দিচ্ছে। নারী ও শিশুদের পুষ্টির কথা বিবেচনা করে তারা খাদ্য সহায়তা অব্যাহত রাখবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করার লক্ষ্যেেউপযুক্ত খাদ্য মান সৃষ্টিতে নানামুখী গবেষণায় লিপ্ত রয়েছে বিশ্ব খাদ্য সংস্থা। ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২০ থেকে শুরু হওয়া জাতিসংঘ ৭৫ তম সম্মেলনে   সমগ্র বিশ্ব নেতাদের কন্ঠে বেড়েছে একই সুর তা হল করোনাভাইরাস থেকে উত্তরণ এবং পরবর্তী সময়ের অর্থনৈতিক ধারা পুনর্গঠন। ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন বা আইএলও করোনার সময়ের কাজ হারিয়ে ফেলা শ্রমজীবী মানুষের পাশে থাকার জন্য ব্যবসায়ী শ্রেণি বা  অর্থনীতি শক্তিশালী দেশ সমূহের প্রতি বিশেষ আহ্বান জানিয়েছেন। মানুষের কল্যাণে গড়ে ওঠা আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ এই করোনাকালে মানুষের পাশে থাকার প্রত্যয়ে  বিশেষ ভূমিকা রাখছে।

বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রার্দুভাব : করোনাভাইরাস এর প্রভাব সমগ্র পৃথিবীর ন্যায় বাংলাদেশেও এর প্রভাব বিস্তার করেছে। ৭ মার্চ ২০২০ সালে ইতালি ফেরত  তিনজন প্রবাসীর শরীরে  করোনাভাইরাস এর প্রথম অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এবং প্রথম করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী মৃত্যুবরণ করে ১৮ ই মার্চ ২০২০ সালে। এরই  ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশ সরকার ২২মার্চ থেকে  সাধারণ ছুটি ঘোষণা দেয় প্রকারান্তরে এটি ছিল বাংলাদেশের লকডাউন এর সূচনা। এপ্রিলের শুরুতে করোনাভাইরাস এর প্রভাব কম থাকলেও এপ্রিলের শেষ দিক থেকে এটি ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। অনেকেই ধারণা করেছিলেন জুন এবং জুলাই মাসে এই মহামারি ভাইরাসের প্রভাব বাংলাদেশে কমে আসতে পারে, কিন্তু বাস্তবতা হলো ভাইরাস এর প্রভাব  কমেনি বরং বেড়েছে।মৃত্যুহার কিছুটা কম থাকলেও সংক্রমণের হার উদ্বেগজনক তবে আশার কথা হলো আক্রান্ত রোগীর বেশির ভাগই সুস্থ হয়ে যাচ্ছে। অশঙ্ককার কথা করোনার ২য় ঢেউ দ্রুত বিস্তার লাভ করছে। ২০২১ এর মার্চ মাস থেকে আবার করোনা নতুন রূপে বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। প্রতিদিন মৃত্যু ঘটছে ১০০ এর অধিক এবং কোভিড পরীক্ষার বিপরীতে ২৩%-২৫% রোগী শনাক্ত হচ্ছে প্রতিদিন। লকডাউনের মাধ্যমে সরকার করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রভাব : বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে কোভিড ১৯ অন্যান্য দেশের মতো জনজীবনে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। শুধুমাত্র জরুরী পরিষেবা, চিকিৎসা ব্যতীত সকল কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়। মানুষের চলাচলের উপর বেশ খানিকটা নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়, প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে না থাকতে সরকার অনুপ্রাণিত করে। বাংলাদেশ করোনায় আক্রান্ত  সংখ্যা আস্তে আস্তে বৃদ্ধি পেয়েছে। স্থবির হয়ে পড়েছিল বাংলাদেশের অর্থনীতি। ফলে শ্রমজীবী মানুষ, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে  নিম্নআয়ের মানুষ সবথেকে বেশি বিপাকে পড়ে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক করোনাভাইরাস এর শুরুতে অনুমান করেছে বাংলাদেশের প্রায় ৯ লক্ষ মানুষ কর্মসংস্থান হারাতে পারে।করোনাভাইরাস ব্যতীত অন্যান্য রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি বিশেষত কিডনি, ডায়াবেটিক, ক্যান্সার রোগী চিকিৎসা চরম ভাবে ভেঙে পড়ে। সরকারি হাসপাতালে কিছুটা ব্যবস্থা করতে পারলেও প্রয়োজনের তুলনায় সেটি খুবই সামান্য। গর্ভবতী মায়েরা এবং সদ্যজাত শিশুরা সবথেকে বেশি বিপদে পড়ে কারণ প্রয়োজনীয় ডাক্তার পাওয়া ছিল দুঃসাধ্য। প্রায় বহির্বিশ্বের সকল দেশের সঙ্গে পণ্য পরিবহনের স্বল্পতার কারণে আমদানি নির্ভর পণ্যসমূহের দাম বৃদ্ধি পেতে শুরু করে যা বাংলাদেশের মানুষের জন্য খুব দুঃসাধ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশ সরকার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার  ৮ থেকে ৯  শতাংশ ধরলেও  বাস্তবতা হলো ২ থেকে ৩ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে না।২২শে মার্চ থেকে  ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত লকডাউনের প্রথম এক মাসেই অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছে এক লক্ষ ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। ইউরোপ আমেরিকাতে লকডাউন চলাকালে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের ক্রয় আদেশ বাতিল হতে থাকে যা পোশাক শিল্পকে এবং এর সঙ্গে জড়িত শ্রমিক ও মালিকে  ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিযেছে। এপ্রিল মাসেই ক্রয়াদেশ হয়েছে মাত্র ৫২ কোটি টাকার যা পূর্ববর্তী বছরের থেকে প্রায় ৮৩ শতাংশ কম। বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি প্রবাসী-আয় যা এ বছরের কমেছে গত বছরের তুলনায় ২২ শতাংশ।সম্প্রতি এক গবেষণায় বলছে বাংলাদেশ নিম্নবিত্তের আয় কমেছে প্রায় ৭৫% এবং হতদরিদ্রের  সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৬০ ভাগ। পর্যাপ্ত ফসল উৎপাদন হলেও মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে যাওয়ার কারণে খাবারের চাহিদা মেটানো পরিবারের জন্য অত্যন্ত দুঃসাধ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২০-২১  অর্থবছরের বাজেট ঘাটতি মেটানোর জন্য বিশ্ব ব্যাংক ও এডিবির কাছ থেকে বড় অংকের ঋণ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার । অনেকে টাকা ছাপিয়ে ব্যয় মেটানোর কথা বললেও মুদ্রাস্ফীতির কথা মাথায় রেখে সেটি থেকে সরে এসেছে সরকার। সরকার ব্যয় সংকোচনের নীতি গ্রহণ করে অর্থসংস্থানের ব্যবস্থা করছে। সমস্ত স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হওয়ার ফলে শিক্ষাব্যবস্থা চরম হুমকির মধ্যে পড়েছে। এপ্রিল মাসে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া এইচএসসি পরীক্ষার ১৩ লক্ষ শিক্ষার্থী  অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। সার্বিকভাবে শিক্ষা ব্যবস্থার উপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ থাকায় পরিবহনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানুষের কষ্ট বেড়েছে। বিশেষত জ্বালানি খাত মন্দার মধ্যে পতিত হয়েছে। পচনশীল  কৃষিপণ্য  যথাসময়ে পরিবহন করা সম্ভব না হওয়ায় কৃষক পড়েছে আর্থিক ক্ষতিতে, ফুলচাষীরা ফুলের গাছ ফেলে দিয়ে অন্য আবাদের দিকে মনোনিবেশ করেছে। মানসিক স্বাস্থ্যের সবথেকে বেশি অবনতি হয়েছে এবং ধারণা করা হচ্ছে সারা পৃথিবীর মত  বাংলাদেশে মানসিক রোগীর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। সমবয়সী মানুষের সঙ্গে ঘুরতে না পারা, দীর্ঘ সময় ঘরে বন্দী থাকা, কাজ হারানো আশঙ্কা, অর্থনৈতিক প্রবাহ কমে যাওয়া মনস্তাত্ত্বিক চাপের সব চেয়ে বড় কারণ। 

করোনাভাইরাস মোকাবেলায় বাংলাদেশ সরকারের পদক্ষেপ সমূহ : করোনাভাইরাসের ভয়াবহতার শুরু থেকেই বাংলাদেশ সরকার অত্যন্ত  সতর্কতার সাথে এবং বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি অবলম্বন করে স্বাস্থ্যবিধির নির্দেশনা প্রদান করেছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সমস্ত নির্দেশনা মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেখভাল করেছেন। প্রতিটি জেলার জনপ্রতিনিধি এবং স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে মতবিনিময় করে স্থানীয় চাহিদাকে  সামনে রেখে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রতিনিয়ত করোনাভাইরাসের তথ্য জনসম্মুখে প্রকাশ করেছে। জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য সময়ে সময়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বাস্থ্যবিধি নির্দেশনা জারি করেছে। স্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রয়োজনীয় সামগ্রীবিশেষ বিবেচনায় দেশে আমদানি  করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ বাহিনী শুরু থেকেই মাঠ পর্যায়ে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনী রাস্তায় অবস্থান করেছে। জনসমাবেশ   রোধ করা, অযাচিত বাইরে ঘোরাফেরা বন্ধ করা, সুরক্ষা সামগ্রী ব্যবহারে মানুষকে উৎসাহিত করা, জনসচেতনতার কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চৌকস দল। সরকার সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর লক্ষ্যে বিশেষ করে কর্মহীন মানুষের  কাছে খাবার পৌঁছে দেওয়ার জন্য ১০ টাকা কেজি দরে রেশন কার্ড এর আওতাভুক্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৫০ লাখ করেছে। ইউনিয়ন পর্যায়ে থেকে শুরু করে ওয়ার্ড পর্যায় পর্যন্ত, গ্রাম বাংলার সর্বত্র মানুষের কাছে বিনামূল্যে খাবার পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে সরকার। পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে বিত্তবান মানুষের কাছে সরকারের পক্ষ থেকে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানানো হয়েছে। বাংলাদেশের প্রতিটি মসজিদের  মুয়াজ্জিন ও ইমামদের জন্য ৫০০০ টাকা করে বরাদ্দ দিয়েছেন। কাজ হারানো মানুষকে সহায়তা দেওয়ার জন্য সরকার প্রতি ইউনিয়ন থেকে ৫০ জনের অধিক ব্যক্তিকে  ২৫০০ টাকা করে নগদ অর্থ সহায়তা প্রদান করেন। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারি গুদামে ২১ লাখ মেট্রিক টন খাদ্য মজুদের নির্দেশনা জারি করা হয়।  কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সরকার ৩ বিলিয়ন ডলার প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। টিসিবির মাধ্যমে স্বল্পমূল্যে মানুষের কাছে খাদ্য পৌছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে বাংলাদেশ সরকার। করোনাভাইরাস এর সময় সম্মুখ যোদ্ধা অর্থাৎ পুলিশ, স্থানীয় প্রশাসন ও নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত সকল বাহিনীর সদস্য, ডাক্তার, নার্স ও সেবা কাজে জড়িত অন্যরা, এবং ব্যাংক কর্মকর্তাদের জন্য সরকার স্বাস্থ্য বীমা চালু করেছে।  চিকিৎসক ও নার্স স্বল্পতার কথা বিবেচনা করে অতি দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন এবং ২০০০ জন নতুন ডাক্তার ও ৬০০০ নার্স নিয়োগ দেয়া হয় । ডিজিটাল সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে হেল্পলাইন চালু করা হয়েছে-  জাতীয় কল সেন্টার- ৩৩৩,  জাতীয় হেল্পলাইন ১০৯, স্বাস্থ্য বাতায়ন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের হেল্পলাইন ০৯৬১১৬৭৭৭৭৭। দেশে প্রায় ৬৮টি  ল্যাবের মাধ্যমে  করোনাভাইরাস পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সচল করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার প্রথমে ৯৫ হাজার কোটি টাকার আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। বিশেষভাবে বৃহৎ, মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পের অর্থনৈতিক প্রবাহকে ঠিক রাখার জন্য এই প্রণোদনা দেওয়া হবে। লকডাউন শিথিলের মাধ্যমে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে গতিশীল করার লক্ষ্যে সরকার পোশাক শিল্প আস্তে আস্তে খোলার পদক্ষেপ গ্রহণ করে ।বিশেষ প্রয়োজনে বাইরে বের হলে অবশ্যই  মাস্ক ব্যবহারের বিষয়ে বিধিমালা জারি  করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য ঝুকি বিবেচনা করে এইচএসসি পরীক্ষার্ বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে।শিক্ষার্থীদের ফল ঘোষিত হবে জেএসসি ও এসএসসির ফলের ভিত্তিতে। সরকার অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে দেশের মানুষকে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব থেকে রক্ষা করার লক্ষ্যে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করোনাকালীন সময়ে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পরিস্থিতির সাময়িক ও দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন। অক্সফোরড- অ্যাস্ট্রেজেনেকা উদ্ভাবিত ভ্যাকসিন যা ভারতের সিরাম ইন্টিটিউট কোভিশিল্ড নামে উৎপাদন করেছে। বেক্সিম্ক কম্পানির মাধ্যমে ২৫ জানুয়ারি ২০২১ সালে দেশে প্রথম ভ্যাসকিসিনের চালান প্রবেশ করে। ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ তারিখ থেকে বাংলাদেশে করোনার টিকা প্রদান শুরু হয়েছে। প্রথম দিকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে সম্মুখসারির করোনা যোদ্ধা বিশেষত ডাক্তার,পুলিশ,প্রশাসন, বিজিবি,র‌্যাব ,আনসার এবং ৪০ বছরের ওপর যে কোনো নাগরিক। ১৮ বছরের কম বয়সী নারী, সন্তান সম্ভবা নারী, স্তন্যদানকারী নারী, জ্বরে ভুগছেন এমন কেউ, করোনা থেকে সুস্থ হওয়ার পরবর্তি ৪ সপ্তাহ না হওয়া ব্যক্তি ,ঔষধে এ্যালাজির্ আছে এমন ব্যক্তির টিকা নেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে বলা হয়েছে । এ্যাপ ব্যবহারের মাধ্যমে নিবন্ধন নিশ্চিত করে টিকা গ্রহণ করতে হবে। টিকা গ্রহণের পদ্ধতি-

  • নিবন্ধন: জাতীয় পরিচয়পত্র যাচাইয়ের মাধ্যমে ব্যক্তি নিবন্ধন
  • ভ্যাকসিন কার্ড: ওয়েব পোর্টাল হতে ভ্যাকসিন কার্ড সংগ্রহ
  • এসএমএস বার্তা প্রেরণ: ভ্যাকসিন প্রদানের তারিখ ও তথ্য প্রেরণ
  • প্রথম ডোজ: নির্দিষ্ট তারিখ ও সময়ে প্রদান
  • দ্বিতীয় ডোজ: নির্দিষ্ট তারিখ ও সময়ে প্রদান
  • ভ্যাকসিন সনদ: দুইটি ডোজ নেওয়ার পর পোর্টাল হতে সংগ্রহ

উপসংহার: ভয় নয় সচেতনতাই জয়-  এই  বাস্তবতাকে ধারণ করে বর্তমান সময়ে আমাদের জীবন ধারণ করতে হবে। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব থেকে রক্ষা পেতে সমগ্র পৃথিবীর মানুষকে অপেক্ষায় আছে একটি উপযোগী ও কার্যকরী প্রতিষেধক এর দিকে। টিকা আবিষ্কৃত না হওয়া পর্যন্ত মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। মনোবল অটুট রেখে নতুন পরিবেশকে মানিয়ে চলা এবং সংকট উত্তরণে সচেষ্ট থাকতে হবে। সমগ্র পৃথিবীকে এক হয়ে লড়াই করতে হবে এই অদৃশ্য   শত্রুর বিরুদ্ধে।  বিশ্বসংসার আবারো ফিরে পাবে তার আপন মহিমা, কর্মময় হয়ে উঠবে মানুষের জীবন, শান্তির সুবাতাস বয়ে যাবে মানবসমাজে এই আজ সমস্ত জগৎ সংসারের  একমাত্র কামনা।

2 thoughts on “নভেল করোনাভাইরাস প্রবন্ধ”

  1. Pingback: Coronavirus Paragraph | Cholo Shekhe

  2. Pingback: Coronavirus Composition | Cholo Shekhe

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top