প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষার ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো

Spread the love

প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষার ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো

প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষা বলতে সেই পুরানাে ভাষাকে বােঝায়, যার সাধুরূপ দুটি- বৈদিক ও সংস্কৃত। বৈদিক ও সংস্কৃত-এর কোনটিই ঠিক কথ্য অর্থাৎ মুখের ভাষা ছিল না; শুধুই ছিল সাহিত্যের ভাষা। প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষা বললে কেবল বৈদিক ও সংস্কৃত ভাষা নয়; বরং এর পিছনে যে কথ্য ভাষা ছিল তাকেও বুঝতে হবে। বৈদিক ও সংস্কৃত মােটামুটি অভিন্ন হলেও দুয়ের মধ্যে কিছু মৌলিক ও প্রচুর কালগত ব্যবধান রয়েছে। অতএব সংস্কৃত ও প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষা সর্বদা সমার্থক নয়। তাই কেবল বৈদিক ভাষাকেও প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষা বােঝায় না। বৈদিক বলতে মূলত ঋগবেদের ভাষাকে বােঝায় । বৈদিক সাহিত্যের শেষ সময়ে প্রাচীন উপনিষদগুলি লেখা হয়েছিল। এগুলির ভাষা বৈদিক লক্ষণ পরিহার করে অনেকটা সংস্কৃতের কাছাকাছি এসে পৌঁছে ছিল। সে দিক থেকে উপনিষদের ভাষাকে সংস্কৃতের পূর্বরূপ বলা যায় ।

প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার ব্যাপ্তিকাল খ্রি. পূর্ব ১৫০০ – ৫০০ অব্দ পর্যন্ত। ভাষা প্রবাহের ঐতিহাসিক বহমানতায় এই দীর্ঘ সময়পরিধি নানা বৈচিত্র্যে তাৎপর্যপূর্ণ । প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষায় যেমন দেখা যায় আঞ্চলিক ও উপভাষাগত বিভেদ তেমনি অপরদিকে এর কালানুক্রমিক বিবর্তনের রূপরেখাও অঙ্কন করা আবশ্যক।

ড. সুকুমার সেন ভারতীয় আর্যের স্তর বিভাজন করেছেন নিম্নরূপে :
(ক) প্রাচীন ভারতীয় আর্য (বৈদিক সংস্কৃত) খ্রি. পূর্ব ১২০০ থেকে ৬০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। এ কাল নির্দেশ আনুমানিক।
(খ) মধ্য ভারতীয় আর্য খ্রি. পূর্ব ৬০০ শতক থেকে খ্রিস্টীয় দশম শতক পর্যন্ত। এ কালপর্ব অনেকটা তথ্য নির্ভর ।
(গ) নব্য ভারতীয় আর্য খ্রিস্টীয় দশম শতক থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত।

ভারতীয় আর্য ভাষার বিভিন্ন স্তর বিভাগ :
১। প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা : বৈদিক মন্ত্র রচনা শুরু (খ্রি. পূর্ব ১৫০০ – ১২০० অব্দ) থেকে গৌতম বুদ্ধের আবির্ভাবের পূর্ব পর্যন্ত (৫৫৭ – ৪৭৭ খ্রি. পূর্বাব্দ)।
২। মধ্য ভারতীয় আর্যভাষা : খ্রি. পূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দী থেকে ২০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এ ভাষার বিবর্তনকাল। মধ্য ভারতীয় আর্যভাষার স্তরকে তিনটি উপস্তরে বিভক্ত করা হয়েছে । যথা :
(ক) খ্রি. পূর্ব ৬০০ অব্দ থেকে খ্রি. পূর্ব ২০০ অব্দ পর্যন্ত আদিযুগ|
(খ) ২০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৬০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মধ্যযুগ।
(গ) ৬০০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে নব্য ভারতীয় আর্যভাষার আদিপর্বের সূত্রপাত হয়।

প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার (বৈদিক ভাষার) সাধারণ লক্ষণ :
(ক) মূল আর্যভাষা থেকে প্রাচীন ভারতীয় আর্য তথা সংস্কৃত স্বরের সংখ্যা কমে গিয়েছে। হ্রস্ব ও দীর্ঘ ৯, ঋ, এ, ঐ সহ স্বরবর্ণ এবং শ, ষ, স সহ ব্যঞ্জনবর্ণগুলির বৈদিক স্তরে যথাযথ ব্যবহার শুরু হয়েছে ।
(খ) বিভিন্ন যুক্ত ব্যঞ্জনের ব্যবহার বৈদিক বর্ণমালার একটি জড় বৈশিষ্ট্য : ক্র, ক্ল,স্ম,র্ত,র্ক,দ্ধ ইত্যাদি।
(গ) শব্দরূপে ছিল ব্যাপক বৈচিত্র্য। বিশেষ্য, সর্বনাম, সংখ্যাবাচক শব্দ, এবং তাছাড়া স্ত্রীলিঙ্গ, পুংলিঙ্গ ইত্যাদি ভেদে বিভক্ত ছিল।
(ঘ) ধাতু বা শব্দের প্রথমে উপসর্গ যুক্ত হলেও তাদের স্বাধীন ব্যবহার যথেষ্ট ছিল না।
(ঙ) দুটি সন্নিহিত স্বরধ্বনির সন্ধি হত।
(চ) সমাসের বিচিত্র ও বহুল প্রয়ােগ ছিল ।
(ছ) বাক্যে পদবিন্যাসের সুনির্দিষ্ট কোন বিধির প্রয়ােজন ছিল না।
(জ) ধাতুর সঙ্গে কৃৎ প্রত্যয় এবং শব্দের সঙ্গে তদ্ধিত প্রত্যয় যােগ করে ইচ্ছে মতাে শব্দ গঠন করা যেতো।
(ঝ) ছন্দ পদ্ধতি ছিলাে অক্ষরমূলক।

আনুমানিক খ্রি.পূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে বৈয়াকরণ পাণিনি সংস্কৃতের কাঠামাে তৈরি করেছেন তাঁর অষ্টাধ্যায়ী ব্যাকরণে। উদীচী তখনকার শিষ্ট প্রধান ভাষা ছিল। পাণিনির ব্যাকরণে এই অঞ্চলের ভাষাই আদর্শ ভাষারূপে গৃহীত হলাে। সংস্কৃত ও বৈদিক ভাষার মধ্যে অনেক পার্থক্য দেখা যায়। ধ্বনিগত দিক থেকে বৈদিক ভাষা ও সংস্কৃতের মধ্যে ঐক্য থাকলেও এ দুই ভাষার মধ্যে ব্যাকরণগত অনেক বৈষম্য লক্ষ্য করা যায়। নিচে সে সম্পর্কে আলােচনা করা হল :

(ক) সংস্কৃতে স্বরের (accent) কোন স্থানে নির্দিষ্ট ছিল না। স্বরের স্থান পরিবর্তনে বৈদিকে অর্থের পরিবর্তন হতাে।
(খ) বৈদিক শব্দরূপ ও ধাতুরূপ বিপুল ও বিচিত্র ।
যেমন- শব্দের একবচনে -নরঃ ও দ্বিবচনে- নরা।
(গ) বৈদিকে ধাতুরূপের বৈচিত্র্য অনেক বেশী । ঠিক ততটা সংস্কৃতে পরিলক্ষিত নয় ।
(ঘ) বৈদিকে ক্রিয়ার ভাব ছয়টি : নির্দেশক, অনুজ্ঞা, সম্ভাবক, বিধিলিঙ, অভিপ্রায়, নির্বন্ধ। সংস্কৃত ভাষায় প্রথম চারটি পাওয়া যায়। অভিপ্রায় ও ভাবের প্রয়ােগ সংস্কৃতে একেবারে নেই। প্রয়ােগ ছিল।
(চ) বৈদিকে সাধারণ দুটি পদে সমাস গঠিত হতাে। তবে সংস্কৃতে দুইয়ের বেশি পদে সমাস নিষ্পন্ন হয়।

বৈদিক ও সংস্কৃত উভয়ই ছিল প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষা। আজকের বাংলা ভাষার বৃহৎ বৈশিষ্ট্য প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষার সাথে মিলে যায়।

1 thought on “প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষার ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো”

  1. Pingback: বাংলা ভাষার ইতিহাস ও ব্যবহারিক বাংলা সাজেসন্স | Cholo Shekhe

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top