মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষার স্থিতিকাল ও তার ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য লেখ

Spread the love

মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষার স্থিতিকাল ও  তার ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য লেখ

ভারতীয় আর্যদের মুখের ভাষা প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে ক্রমেই পরিবর্তিত হয়ে এক সময় এক নতুন যুগের সূচনা হয়- সে নতুন যুগের ভারতীয় আর্যভাষার নাম মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষা। প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার যুগগত নাম যেমন ‘বৈদিক সংস্কৃত’, মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষার যুগগত নাম ‘প্রাকৃত ভাষা’। ড . মুহম্মদ শহীদুল্লাহ মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষাকে তিনটি উপস্তরে ভাগ করে প্রথম উপস্তরটির নাম দিয়েছেন- ‘প্রাচীন প্রাকৃত (খ্রি: পূ: ৫০০ থেকে ১০০ খ্রি: পর্যন্ত), দ্বিতীয় উপস্তরটির নাম – ‘মধ্যপ্রাকৃত (২০০ খ্রি: থেকে ৪৫০ খ্রি: পর্যন্ত), তৃতীয় উপস্তরের নাম ‘অপভ্রংশ (৪৫০ থেকে ৬৫০ খ্রি: পর্যন্ত)। ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় সহ ভারতীয় পণ্ডিতগণের ধারণা- মধ্য ভারতীয় আর্যভাষার ব্যপ্তিকালে ৬০০ খ্রি: পূ:থেকে ৯০০ খ্রি: পর্যন্ত । 

মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষার প্রথম উপস্তরে রয়েছে অশােকের অনুশাসন লিপি, সাঁচি ও বার্হুতের প্রস্তরলিপি, খারবেল লিপি, প্রভৃতি ভাষা। ‘পালি’ প্রাচীন প্রাকৃত থেকে উৎপন্ন একটি সাহিত্যিক ভাষা। পালি গড়ে উঠেছে সাহিত্যের ভাষার ধারায়, যে ধারায় সংস্কৃত এবং সাহিত্যিক প্রাকৃত গড়ে উঠেছিল। এরপর মধ্য ভারতীয় আর্যের দ্বিতীয় উপস্তরে অর্থাৎ মধ্য প্রাকৃতে আমরা পাই- সাহিত্যে ব্যবহৃত মাগধী, মহারাষ্ট্রী, শৌরসেনী এবং মহাযানী বৌদ্ধদের ‘বৌদ্ধ-সংস্কৃত। এ ভাষাগুলাের পরিচয় পাওয়া যায় প্রথম তিন শতাব্দীর নানান প্রত্নলিপিতে । এ উপস্তরের ভাষাকেও সাহিত্যিক প্রাকৃত বলা হয়েছে। মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষার পরবর্তী পর্যায়ে আসে ‘অপভ্রংশ’। এ উপস্তরটির প্রাকৃত ভাষা আগের এবং পরবর্তী নব্য ভারতীয় আর্য ভাষাগুলোর আদি স্তরের মাঝামাঝি। অপভ্রংশ নামটি মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষার শেষ স্তর হিসেবে চিহ্নিত হলেও প্রাকৃত ভাষার বৈয়াকরণগণ একে একটি আলাদা ভাষা হিসেবে মনে করে একে মধ্য ভারতীয় আর্যভাষার কথ্যরূপ হিসেবে বিচার করে এর নাম দিয়েছিলেন-অপভ্রংশ।

মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষার ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য :
মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষার বিভিন্ন সময়ে যে উপস্তরগুলাে গড়ে উঠেছিল, তাদের প্রত্যেকটির কিছু স্বতন্ত্র ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য ছিল । তবে যে বৈশিষ্ট্যগুলাে মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষার সব উপস্তরে লক্ষিত হয়, সেগুলাের সংক্ষিপ্ত রূপ তুলে ধরা হলাে:

ক. ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য :

১. ‘ঋ’ ও ‘৯’ প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষার এ দুটি বর্ণ মধ্য ভারতীয় আর্য স্তরে এসে লুপ্ত হয়ে যায়। ‘৯’ বর্ণটি বৈদিক-সংস্কৃতের শেষে শুরু হয়ে মধ্য ভারতীয় আর্যে এসে বিলুপ্ত হয়। ‘ঋ’ বর্ণটি বিভিন্ন প্রাকৃতে ভিন্ন ভিন্ন ধ্বনিতে পরিণত হয়।
যেমন- ঋ>অ/ই/উ/এ-(মৃগ > মগ,মিগ,মুগ; বৃদ্ধ > বুড়;ঋষি > ইসি) ইত্যাদি।
২. যৌগিক স্বর ‘ঐ’ এবং ‘ঔ’ একক স্বরে, অর্থাৎ ‘এ’ এবং ‘ও’-তে পরিণত হয়।
যেমন- ঐ > এ (ধর্মানুশস্তৈ > ধম্মানুসৃথিয়ে); ঔ > ও (ঔষধানি > ওসধানি); ইত্যাদি।
৩. ‘অয়’ এবং ‘অব’ সংকোচনের ফলে যথাক্রমে ‘এ’ এবং ‘ও’ স্বরধনিতে পরিণত হয়।
যেমন- অয় > এ (পূজয়তি > পূজেতি/পূজেদি/পূজেই) অর> ও (ভবতি > ভােদি/হােদি/হােই); ইত্যাদি।
৪. পদের শেষে অবস্থিত অনুস্বারের (ম>ং) পূর্ববর্তী এবং যুক্তব্যঞ্জনের পূর্ববর্তী দীর্ঘস্বর হ্রস্বস্বরে রূপান্তরিত হয়।
যেমন- কান্তাম, > কান্তং, দীর্ঘ < দিগম; ইত্যাদি ।
৫. পদের শেষে অ-কারের পর অবস্থিত বিসর্গ (ঃ)লােপ পেয়েছে এবং বিসর্গের পূর্ববর্তী অ-কার কখনাে ও-কারে, কখনাে এ-কারে পরিণত হয়েছে।
যেমন- জনঃ > জন > জনে > জনাে; ইত্যাদি।
৬. পদের শেষে অবস্থিত অনুস্বার (ং) সাধারণত রয়ে গেছে ।
যেমন- পরম্ > নরং; ইত্যাদি।
৭. শ,ষ,স- এ তিনটি শিষ ধ্বনির জায়গায় কোনাে প্রাকৃতে ‘শ’, কোনাে প্রাকৃতে স’ প্রচলিত ছিল।
যেমন- শুশ্রুষা > সুস্রষা/সুসুষা; ইত্যাদি ।

খ. রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য :

১. মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষায় দ্বি-বচন লােপ পায়। ফলে শব্দরূপে শুধু একবচন ও বহুবচনে রূপভেদ থেকে যায়; দ্বি-বচনের স্থানে বহুবচনের রূপ ব্যবহৃত হতাে।
যেমন- ঘৌ-ময়ূরৌ > দ্বো-মােরা; ইত্যাদি ।
২. মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষার বিশেষ্য ও সর্বনামের শব্দরূপ প্রাচীন ভারতীয় আর্যের মতাে ভিন্ন না হয়ে বিশেষ্যের শব্দরূপ সর্বনামের শব্দরূপের মতো দেখা যায়।
৩. প্রাচীন ভারতীয় আর্যের শব্দরূপ ও ক্রিয়ারূপের দ্বি-বচন মধ্যে ভারতীয় আর্যে এসে লােপ পেয়েছে। সে জায়গায় বহুবচনের রূপ ব্যবহৃত হতাে।
৪. প্রাচীন ভারতীয় আর্যের পাঁচটি ক্রিয়ার ভাবের (Mood) মধ্যে ‘অভিপ্রায’ ও ‘নির্বন্ধ’ লােপ পেয়েছে। প্রাকৃতে ছিল শুধু নির্দেশক, অনুজ্ঞা ও সম্ভাবক।
৫. প্রাচীন ভারতের পাঁচটি ক্রিয়ার কালের (Tense) ভেতর অতীত কালের (লঙ, লুঙ ও লিট) লিট একেবারেই লােপ পেয়েছে।
৬. মধ্য ভারতীয় আর্যে প্রাচীন ভারতীয় আর্যের ‘ত্বা’, ‘ত্বায়’ ইত্যাদি যুক্ত করে অসমাপিকা ক্রিয়ার বৈচিত্র্য বজায় থাকেনি।

গ. বাক্যতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য :

১. প্রত্যেক কারকের সুনির্দিষ্ট বিভক্তি ছিল প্রাচীন ভারতীয় আর্যে। কিন্তু মধ্য ভারতীয় আর্যে এসে অনেক বিভক্তি লােপ পেয়েছে। এর ফলে বাক্যের ভেতর শব্দের অবস্থানের ওপর তাদের ভূমিকা ও পরিচয় নির্ভরশীল ছিল । এ কারণে বাক্যে পদ-বিন্যাসক্ৰমের নিয়মের গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে।
২. মধ্য ভারতীয় আর্যে কোনাে কোনাে বিভক্তি লােপ পাওয়ায় বিভক্তির অর্থে কিছু স্বতন্ত্র শব্দ, প্রত্যয় ও অনুসর্গের প্রচলন হলাে।

ঘ. ছন্দোরীতিগত বৈশিষ্ট্য:

মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষার ছন্দ ছিল ‘মাত্রামূলক’ বা ‘মাত্রাবৃত্ত’। কবিতার চরণ বা পংক্তিগুলাে প্রথমে বিষমমাত্রিক থাকলেও পরে তা সমমাত্রিক নিয়মে লেখা হত। প্রাচীন ভারতীয় আর্য থেকে বর্তমান পর্যন্ত ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য অনুপ্রাস বা মিল না থাকলেও মধ্য ভারতীয় আর্যে এসে পংক্তির শেষে অন্ত্যানুপ্রাস বা মিলের প্রচলন শুরু হয়েছিল ।

1 thought on “মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষার স্থিতিকাল ও তার ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য লেখ”

  1. Pingback: বাংলা ভাষার ইতিহাস ও ব্যবহারিক বাংলা সাজেসন্স | Cholo Shekhe

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top